Wednesday 16 May 2018

ভিন্ন স্বাদের ভ্যাকেশন


খুব একটা প্ল্যানিং না করে বেরিয়ে পড়লাম !
কর্তা অফিসের কাজে টুরে| তার মধ্যে দুদিন স্কুল অফিস ছুটি, উইক এন্ড নিয়ে চার দিন!
১৩ বছরের ছেলেকে নিয়ে চার দিন বাড়িতে বসে থাকার কোনো মানেই হয় না!  এমনিতে সারা সপ্তাহ কাজের পর ছুটিতে বাড়িতে বসে থাকতে হয়তো ভালোই লাগে তবে এক্ষেত্রে সমস্যা দুইখান।
এক হলো, বাড়িতে থাকলে সংসারের কাজের কোনো শেষ নেই। ওয়াশিংমেশিন আর ডিশওয়াসার  যেন সারাদিন হাতছানি দিয়ে ডাকে । ঘরের কোনে কোথাও ধুলো, কোথাও ঝুল উঁকি মারে, শান্তি মনে বসতে দেয় না ।
দুই হলো এই যে তেরো বছরের ছেলেটি, ছুটি থাকলে তার হাত থেকে ওই সর্বনাশী মেশিনটা নামানো মুশকিল।  হয় ফোন, নয় ipad !!
উপরোক্ত দুই সমস্যার হাত থেকে খানিক মুক্তি পাবার আশায় দুইজন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম Groningen শহর এর পথে ।
ওখানে এক বান্ধবী অনেকদিন  ধরেই বলছিলো আসতে, হয়ে উঠছিলো না। 
সুযোগ হলো ।

অফিসে অনেকে শুনে বললো, দূর দূর ওখানে কিস্সু নেই । তারওপর  যখন শুনলো যে ১৩ বছরের ছেলে আর আমি যাচ্ছি, একজন বললো, একটু রিস্কি হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা? ওখানে ১৩ বছরের ভালো লাগার তেমন কিছু নেই। ছেলে বোর হয়ে যাবে একেবারে!
কেউ কেউ মুচকি হেসে বললো, "ভালোয় ভালোয় ঘুরে এসো ", কোথায় যেন সেই মুচকির মধ্যে একটু সাবধানবাণী !

যাগ্গে, ছেলেকে প্রস্তাবটা দিলাম ! তখন অবশ্য সব বুকিং হয়ে গেছে , তাই ঠিক প্রস্তাব নয় ।
এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা । জিজ্ঞেস করলো, "ওখানে গিয়ে কি করবো?"
যাচ্ছলে !এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক তৈরী ছিলোনা।

...মানে .....ওই টুরিস্টদের মতন ঘুরে ঘুরে শহরটা দেখবো!
[মা তখন যা মাথায় এলো বলে দিলো]

"কি আছে দেখার? আমি কিন্তু কোনো মিউজিয়াম যাবো না। আমি বেশি হাঁটবো না কিন্তু বলে দিলাম "

....আরে নানা, আমরা দুজন রিলাক্স করবো খালি। একটু বেরোবো, একটু হোটেলে থাকবো , একটু খাবো , ছবি তুলবো। ..ব্যাস!
[মা তখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে মাথা ঠান্ডা রাখার]

"হোটেল এ নিশ্চয় wi-fi  আছে?'

...সে তো আছেই, সাথে সুইমিং পুল ও আছে।
[মা তখন প্লানটা ভালো লাগানোর জন্য মরিয়া]


"তাহলে কিন্তু হোটেল থেকে কোথাও বেরোবো না"

মা মাথা নাড়লো ।এক গাল হেসে মেনে নিলো ছেলে।
[মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো , মনে মনে বললো, আগে তো চলো, তাপর দেখছি !!]

মা ছেলের এমনি ভ্যাকেশন  এই প্রথম ! 
খুব  হৈ  হৈ করে আমরা প্যাকিং করে ফেললাম। রাস্তায় খাবার জন্য ব্যাগে  চিপস, চকোলেট আর কিছু ফ্র্রুট জুস্ ।জামা কাপড় , সুইমিং কস্টিউম, গল্পের বই, ipad , বিভিন্ন রকমের চার্জার ইত্যাদি নিয়ে রওনা হলাম।
সত্যি কিন্তু একটা ভিন্ন স্বাদের  ভ্যাকেশন !

"মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে মা কে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে ........."


ট্রেনে বেশ খানিকটা রাস্তা, প্রায় আড়াই ঘন্টা। দুর্ভাগ্যবশতঃ  লাস্ট এক ঘন্টা আবার রেল লাইনে কাজ হচ্ছে বলে ট্রেন বন্ধ , তাই ট্রেন থেকে নেমে বাসের ব্যবস্থা। মজাই লাগলো, একটু যেন রোমাঞ্চকর । ছেলে অবশ্য মুখ গুঁজে তার হাতের মেশিন নিয়ে ব্যস্ত। মা মাঝে মাঝে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গল্প করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। কখনো বা পুরো একটা গোটা বাক্য উত্তর কখনোবা কেবল হুঁ দিয়ে কাজ সাড়া উত্তর! মা তাতেই খুশি!
পিকনিকের মতন ব্যাগ খুলে মাঝে মাঝে চিপস বার করে খাওয়াতে অবশ্য ভুলছিলো না ছেলে ।

প্রথম হোঁচট খেলাম হোটেলের রিসেপশনে । হোটেলের মেন্ বিল্ডিং এ সুইমিং পুল আছে তবে সিটি সেন্টার এর এই ব্রাঞ্চ এ পুল নেই । আমার তো মাথায় হাত । ছেলে নিশ্চয় খুব দুঃখ পাবে, এই ভেবে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম ছেলে মন দিয়ে wifi পাসওয়ার্ড নিচ্ছে । বেশি ঘাঁটালাম না । একটু দুঃখ পেলো ঠিকই তবে তেমন কিছু বড় আঘাত বলে মনে হলোনা । 
মালপত্র রেখে বন্ধুর সাথে তার বাড়ি গিয়ে সারা সন্ধে জমিয়ে আড্ডা মারলাম । Physics থেকে Philosophy --কিছুই বাদ গেলোনা। তারপর মন মাতানো রকমারি রান্না দিয়ে পেট পুজো সারলাম ।


পরের দিন আসল ভ্যাকেশন ফিলিং । সকাল সকাল হোটেল এ জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে । খুব সুন্দর সাজানো সিটি সেন্টার । ছোট ছোট দোকান, সুন্দর চার্চ , পাশে ক্যানাল , তাতে নৌকো, ...ছবির মতন । দিশাহীন ভাবে হেঁটে বেড়াতে খুব ভালো লাগলো। ১৩ বছরের ছেলের অবশ্য একটু ঘুরে পা টনটন শুরু হয়ে গেলো। শান্তি বজায় রাখতে উঠে পড়লাম নৌকায়, সাথে লাঞ্চ এ পিজা খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি। রোদ ঝলমল দিন, ফুরফুরে হাওয়া , হাতে ক্যামেরা  ....দারুন রিলাক্স একটা ভাব। পাশে তাকিয়ে দেখলাম ছোট কর্তার মুখ চোখ ভীষণ ব্যাজার --এমন ভাবখানা যেন নৌকো ভ্রমণের মতন বিরক্তিকর কাজ আর দুটো হয়না ।
চোখাচোখি হতে বললো, "বোর হচ্ছি"..
এই জেনারেশন আবার খুব সহজেই বোর হয়ে যায়!!
একটু কথোপকথনের শুরু করার ইচ্ছে নিয়ে বললাম , 'দ্যাখ দ্যাখ ওই ব্রিজটা কি সুন্দর"...
উত্তর এলো,  "exactly same ব্রিজ একটা Den Haag এও আছে"
দমে যাবার পাত্রী আমি নই। ..
বললাম, "same নয়. তবে হয়তো similar "
চালাক ছেলে, দেখলো মা এর এই মুড বজায় রাখার জন্য চুপ থাকাই  ভালো।....
;-)
নৌকো বিহার সেরে খুঁজে পেতে ঢুকলাম গিয়ে এক ইতালীয় রেস্তোরাঁয়। ....দুজনের পেটেই তখন ছুঁচোদের কীর্তন শুরু হয়েছে । ফুটবল ফিল্ডের মতন সাইজের পিজা এসে গেলো। খুশিমনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম দুজনে । পেটে  খাদ্য ঢুকলো, আমাদের গল্প ও শুরু হলো । নানা রকমের টপিক। লাইফ আর বোরিং রইলো না, খাদ্য রসিকরা জমিয়ে খেলো। বন্ধুর মতন শেয়ার হলো অনেক গল্প ।


এরপর আরো কিছুক্ষন ঘুরে বেড়াবার ইন্ধন পেটে নিয়ে আমরা আবার হাঁটলাম।



"মা এই মিউজিয়াম তা দেখতে চাই"
ঠিক শুনছি তো? কি বললে?
"মিউজিয়াম তা মনে হয় ইন্টারেস্টিং হবে, লেখা আছে "Welcome Modern Man "..

পুত্রের এহেন অনুরোধ এ যারপরনাই খুশি হয়ে মাতৃজননী তৎক্ষণাৎ টিকিট কেটে ভেতরে।....
এক্ষেত্রে ভেতরে ঢুকে অবশ্য মাতৃজননী একটু নিরাশ হলেন। ওই মডার্ন আর্ট ব্যাপারটা আবার আমি ঠিক ভালো বুঝিনা । এখনো পাহাড় নদী সূর্য ফুল , এইসব দেখতেই ভালো লাগে ।যীশুখ্রিষ্টর পেটের ভেতর থেকে একটা কঙ্কালের হাত বেরিয়ে আছে,  কিংবা জলপ্রপাতের সামনে একটি মৎসকন্যা  একটা কাঁটা গাছ কোলে নিয়ে বসে আছে....এই ধরণের আর্ট আমার মাথা কিংবা হৃদয় কেউই বোঝে না ! 
ফলে ব্যাজার মুখে বেরিয়ে এলাম।
নাহ , এবার একটা কফি খেতেই হচ্ছে। ..

ক্যানালের ধারে বসে লোকজন দেখতে দেখতে কফি খেলাম। বিকেলে আবার বান্ধবীর সাথে আড্ডা আর Thai রেস্তোরায় খাওয়াদাওয়া।
Total chill !!!

শনিবার বাড়ি ফেরার পালা।..
ট্রেনে উঠে বললাম, "বেশ কাটলো, তাই না? তোমার কি ভালো লাগলো সব থেকে বেশি?"

"Groningen এ বেস্ট লাগলো. .....হোটেলের wi -fi টা !! দারুন strong ছিল!"

বোঝো ঠেলা!  সত্যি "ভিন্ন স্বাদের ভ্যাকেশন ".......................
;-)


No comments:

Post a Comment