Tuesday 30 October 2018

কুমড়ো পুজো : বাংলায় যাকে বলে Halloween


সবজিটা আমার কোনোদিনই ভালো লাগতো না । যেমন বাজে গন্ধ তেমনি বাজে খেতে। তবে সেটা এতো জোর গলায় সারা বিশ্বকে জানিয়ে বলার সাহস ছিল না । বিশ্ব তো ভুলে যাও, বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে বলার ও তেমন সুযোগ ছিল না। কড়া নিয়ম ছিল থালায় যা দেওয়া হবে সব খেয়ে নিতে হবে, ব্যাস।  ফুলস্টপ! no discussion.
নইলে সেই বড় বড় চোখ, ভাবলে আজও হাঁটু কাঁপে,গলা শুকিয়ে আসে !
ফলে সারা জীবন সুড়সুড় করে কুমড়ো খেয়ে নিয়েছি। চুপচাপ ।
কুমড়োর ছেঁচকি, কুমড়োর ছক্কা, কুমড়ো ভাতে, কুমড়োর চাটনি!
কি সব গ্ল্যামারহীন রেসিপি।
তাই খেয়েছি, নির্বিবাদে।বছরের পর বছর ।

তবে আজ বলতে দ্বিধা নেই এইসব অত্যন্ত বাজে শাক সবজির মর্ম বুঝেছি বাড়ি ছাড়ার পরে ।
বেনারস এর হোস্টেলে যখন নেনুয়ার ঝোল আর ভাত খেতে দিতো তখন মনে হতো, আহা মা কুমড়ো ছেঁচকিটা বড় ভালো বানায় !
জাপানের কলেজ ক্যান্টিনে যখন সামুদ্রিক শ্যাওলা মুড়ে একটা চিকেন দিতো (আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে, শ্যাওলা নয়, seaweed !), তখন ওই কুমড়ো ছক্কার জন্য মন কেঁদে উঠতো!
হল্যান্ড এ ছোট্টবাচ্চা নিয়ে হিমশিম খেতে খেতে যখন রান্না করতাম, ভাবতাম এইসময় কেউ যদি একটু আলুকুমড়ো দিয়ে ভাতেভাত বানিয়ে দিতো!
 কুমড়ো থাকতে কি আর আমরা কুমড়োর মর্ম বুঝি?

তাই (অনেক বছর পরে) আজকাল আমার কুমড়ো ভালোই লাগে!
ছক্কার রেসিপি ইন্টারনেট এ দেখে রান্নাও করেছি। পয়সা খরচ করে ISD তে মা কে জিজ্ঞেস করে জেনেছি কুমড়ো ছেঁচকির কথা। বানিয়েওছি কতবার। তাই দিয়ে এক থালা ভাত ও মেখে খেয়েছি খুশি মনে !আবার বড়াই করে তাই নিয়ে ব্লগ ও লিখেছি!
[হা কপাল কি দিনকাল পড়লো!, সেই anti-কুমড়ো আমি  কিনা  আজ  ....]

তবে যাই বলি না কেন, ইয়ে মানে  ....ওই আর কি .. কুমড়ো কুমড়োই ......
এমনি এমনি তো আর সুকুমার রায় কুমড়োপটাশ নিয়ে ছড়া লেখেননি !!!

" (যদি) কুম্‌ড়োপটাশ ডাকে— 
   সবাই যেন শাম্‌লা এঁটে গামলা চড়ে থাকে; 
   ছেঁচকি শাকের ঘন্ট বেটে মাথায় মলম মাখে; 
   শক্ত ইঁটের তপ্ত ঝামা ঘষতে থাকে নাকে! "

বিদেশে এসে দেখি ওমা এখানে কুমড়োর লাইফই আলাদা । ঠাট-বাট একদম অন্যরকম ।
বিনস, গাজর, বিট, ব্রকলির মতন  সফিস্টিকেটেড সবজিদের সাথে ওঠা বসা !
ক্রিমের মতন অভিজাত উপকরণের সাথে মিলে মিশে সুপ বানানো !
কিশমিশ, কাজু , পেস্তার সাথে হাত ধরাধরি করে কেক!
ভুরভুরে ভ্যানিলা এসেন্স গায়ে লাগিয়ে পুডিং!
আরো শোনো !
কুমড়ো দিয়ে পাস্তা পর্যন্ত!
(মরে যাই)

তারওপর এই হ্যালোউইন এর সময় যা করা হয়, সেটা যেন একেবারে বাড়াবাড়ি!
একটা গোটা ইভেন্ট কুমড়ো নিয়ে মাতামাতি, তার চোখ কান নাক এঁকে তাকে মাথায় চড়ানো । তার মধ্যে আলো জ্বালিয়ে......
আদিখ্যেতা!

যাগ্গে, ফ্রিজ এ কুমড়ো ছিল, বার করে রান্না করতে গিয়ে শুনি।.
(আমি তো আবার ওদের কথা শুনতে পাই).....
ঠিক যতটা ভাব ভেবেছিলাম ওদের মধ্যে ততটা নয়.....
কুমড়োর চেহারা নিয়ে টিটকিরি এখানেও চলে। ......

বিন্স :
আমার চেহারা দেখ লম্বা দোহারা,
যারা দেখে, চটপট প্রেমে পড়ে তারা !

গাজর:
আমার রূপ গুন ভিটামিনে ঠাসা !
সুপে আমি সুস্বাদু,হালুয়াতে খাসা !

বিট:
জগৎ ফিদা মোর রঙের বাহার,
স্টু এ আমি অনবদ্য, রুগীর আহার!

ফুলকপি:
ফুটফুটে ফুল আমি, ডালনা কি ভাজা
পছন্দ সবার আমি, সব সবজির রাজা !

হঠাৎ দেখি কুমড়ো যেন জেগে উঠলো   .........

তোরা বড্ড বেশি রিয়েল, পুষ্টি ভিটামিন,
আমি থাকি রূপকথায়, কিংবা Halloween !
তোরা থাকিস প্লেটে, রোজের খাওয়াদাওয়া,
আমি রথ রাজকন্যের, কল্পনাতে পাওয়া !
মজার আমি, তাই তো লেখেন ছড়া সুকুমার,
তোদের নেই ট্যালেন্ট, কবির ভাব জাগাবার !!

পাশে বসে ব্রকলি শুনছিলো । বললো, 

"Can you explain all that in English please?  I just do not understand the gibberish that you just said Mr. Pumpo!"

কুমড়ো একবার বাকিদের দিকে তাকালো। গড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলো ।তারপর confidently ঝরঝরে ইংরিজিতে বললো,

I am in fairy tales, me the fat pumpkin,
I am the carriage that Cinderella was in!
I am bright orange, favourite of your queen,
I get to light up the evening of Halloween!

সব সবজি কাচুমাচু মুখে সরে পড়লো।
Halloween এর সময় , সত্যি কুমড়োর কনফিডেন্স অন্য লেভেলে!!

আমিও সরে পড়লাম ।
যাই কুমড়ো কেকের রেসিপি দেখি । Halloween এ ঠিক কুমড়ো ছেঁচকি জমবে না !
;-)

Thursday 25 October 2018

ট্রাম অফিস


আজ বেশ কিছুদিন হলো ট্রামে করে অফিস যাতায়াত করছি। আসলে অফিস মুভ হয়েছে, শহরের মাঝখানে। খুব ট্রাফিক জ্যাম হয়, সেখানে গাড়ি চালিয়ে যেতে ইচ্ছে করেনা।
তাই ভাবলাম ট্রাম ট্রাই করে দেখি।

প্রথম দিকে একটু অসুবিধে লাগছিলো ঠিকই, কারণ সবই অভ্যেসের ব্যাপার কিনা।
নিজে গাড়িতে গেলে সব কিছু যেন আমার কন্ট্রোলে। (which is not entirely true, but still.....)
প্রথম  দিকে একটু অধৈর্য লাগতো। স্টপে দাঁড়িয়ে থাকা, মিনিটে মিনিটে ঘড়ি দেখা। 
সব থেকে রাগ লাগতো যখন কিছু সেকেন্ডের জন্য ট্রাম মিস হয়ে যেত। 
মুখের সামনে দিয়ে হুশ .....

ধীরে ধীরে অভ্যেস হতে লাগলো।বাড়ি থেকে অফিস ৫৫ মিনিট। ৫ মিনিট হাঁটা বাদ দিলে ট্রামে ৫০ মিনিট।
সেই ৫০ মিনিটে অনেক রকম কাজ সারতে শুরু করলাম। বই পড়া, হিজিবিজি লেখা। তারপর লোকজন দেখতে শুরু করলাম। কোথা দিয়ে যে ৫০ মিনিট কেটে যায় আজকাল।
আসে পাশের লোকজনদের মুখ চেনা হয়ে উঠলো। প্রত্যেকটি চরিত্র ইউনিক। সকালে স্কুল কলেজ অফিস যাবার expression প্রত্যেকের আলাদা।
মনে মনে কত গল্প ফাঁদতে শুরু করলাম। সে না হয় আরেকদিন বলবো গুছিয়ে ।

আজকের গল্প "ট্রামে করে অফিস" নিয়ে  নয় ।আজকের গল্প "ট্রাম অফিস" নিয়ে।
কল্লোলের ট্রাম অফিস। 
[নেদারল্যান্ডস এ আমাদের বাঙালি ক্লাব কল্লোল]

দুর্গাপুজোর বেশ কিছু মাস আগের থেকেই শুরু হয়ে গেলো কল্লোলের প্রস্তুতি । 
অনেক কাজ। দেশের বাইরে, নিজেদের রোজকার জীবন, কাজ, সংসার ...সব সামলে চারদিন ধরে পুজো করা চাট্টিখানি কথা নয়। শুধু তো মন্ত্র পড়ে পুজো করলে চলবে না । 
বাঙালির পুজোতে আনন্দের ফুল প্যাকেজ চাই । ১০০ এ ১০০!
দেবদেবীর পুজো, including হোম যজ্ঞ অঞ্জলি সন্ধিপুজো যেমন চাই, আবার সাথে চাই পেটপুজোর এলাহি আয়োজন। তাতে ভোগ লাবড়া থেকে ফিস ফ্রাই, কিছু যেন বাদ না পরে।
(কে বুঝি এবার কাসুন্দির ও খোঁজ করেছিলেন)
তারপর চাই কালচার। নাচে গানে ভরপুর প্রোগ্রাম চাই রোজ। তাতে একটা নৃত্যনাট্য চাই, অষ্টমীতে বাংলা নাটক চাই, আবার জীবনমুখী গান ও চাই।
এছাড়া চাই আনন্দমেলা, দেবী বরণ , সিঁদুর খেলা, পুজোসংখ্যার ম্যাগাজিন। ...সব সব ।
দুর্গাপুজো includes everything, all equally important!

দুর্গাপুজোর জাঁকজমক সত্যি অন্য রকম । সে যে দেশেই থাকি না কেন ।
প্রত্যেকটি মুহূর্তের সাথে আমাদের ছোটবেলা জড়িত। প্রত্যেকটি চাহিদার সাথে কিছু স্মৃতি যা ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যেকটি আলোচনায় একটা নিজের দেশের অনুভূতি।
আর তাই বোধহয়, সবাই এত পরিশ্রম করে আমরা বিদেশের মাটিতে এমনি ভাবে পুজো করতে পারি।কোথায় যেন ভক্তি, ভালোবাসা, স্মৃতি, ছোটবেলা, পরিবার, খাওয়াদাওয়া মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। 
ফাইনাল অনুভূতিটা বড্ড আনন্দের!

যাগ্গে যেটা বলছিলাম। ট্রাম অফিস ।
এই পুজোর প্রস্তুতির একটা অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠলো ট্রাম নং ১৭। 
সকাল ৮ থেকে ৮:৫০ আর বিকেল ৫:৩০ থেকে ৬:২০ ট্রাম নং ১৭ হয়ে উঠলো পুজোর অফিস। 

টিম দারুন ব্যস্ত।

"The next stop is Laan Copes van Cattenburch. Do not forget to use your OV chipcard after your stop has been announced......."

"হ্যালো "
"হ্যালো।  হ্যাঁ, ট্রাম থেকে বলছি ........"

"শোনো, মিষ্টির অর্ডার আজকে ফাইনাল করতেই হবে । নবমী রাতে রসমালাই নাকি গুলাবজামুন?"
প্রায় সাড়ে সাত মিনিট রসমালাই Vs গুলাবজামুনের pros/cons ডিসকাস করে তবে নিশ্চিন্ত বাঙালি । রসমালাই definitely !

" আচ্ছা, ইন্ডিয়া থেকে কেউ আসছে? একটা গেরুয়া ধুতি আর ফতুয়া চাই অষ্টমীর নাটকের সাধুর রোলের জন্য"
প্রায় সোয়া এগারো  মিনিট আলোচনার পর ধুতি ফতুয়ার ব্যবস্থা করে তবে নিশ্চিন্ত বাঙালি।

" ম্যাগাজিন software টা download করেছি, version 1.0 pdf করে পাঠালাম, একটু চেক করে ফিডব্যাক চাই, meanwhile whatsapp এ প্রিন্টার নিয়ে কথা বলছি  "
পৌনে নয় মিনিট আলোচনা।  আমাদের লোকাল পুজোসংখ্যা আলোচনা করে নিশ্চিন্ত বাঙালি ।

" চটপট বলো ।  কমিটি মিটিং এর জন্য সিঙ্গারা ৫০ টা  অর্ডার করবো নাকি ৬০? "
পাক্কা ষোলো  মিনিট হেড কাউন্ট করা হলো। যদিও গুনে ৪৫ হচ্ছে তবুও ৬০ টাই অর্ডার করা উচিত, যেন কম না পড়ে । খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বাঙালি কোনো রিস্ক নিতে রাজি নয় ।

তারই মাঝে  .......
"মা, আমার স্পোর্টসএর মোজা কোথায়? খুঁজে পাচ্ছিনা "
"আমার অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হবে, আজকে ডিনার কি?'

"হ্যালো "
"হ্যালো।  হ্যাঁ, ট্রাম থেকে বলছি ........"

"সেকি আনন্দমেলায় ভেজিটেবিল চপ থাকবে না ? কাবাব চাট সামোসা থাকছে....."

"শোনোনা, সপ্তমী প্রোগ্রামের জন্য একটা কাঁথা স্টিচ ওড়না লাগবে"

"All flowers have been ordered. Should I ask them to deliver at 8:00?"

"ধোকার ডালনা অত সোজা না, রেসিপি পাঠিয়েছি কিন্তু আমাদের ফুড টেস্টিং এর ব্যবস্থা করতে হবে"

"স্পন্সরশিপের টাকা এসে গেছে, ইনভয়েস পাঠিয়ে দিলুম"

"Online registration বলছে ৩৫০ অষ্টমীতে !  ১০% বাফার রাখছি তাহলে.."

"তুই sure  ৫ টা ধুনুচি আছে আমাদের স্টোরে ? দশকর্মার জিনিস তো অবশ্য আসছেই "

" বলছি কি, সপ্তমী ভোগ এর জন্য এখনো কাউকে পাইনি  ........"

"পুরোহিত মশাইয়ের হোটেল বুক করে দিয়েছি, date তা একটু চেক করে নিও "

"নানা, হলটা পঞ্চমীর দিনেও বুক করে দিতে হবে..logistics ডিসকাস হয়নি আগের দিন "

"আচ্ছা রিহার্সাল এ কি বিরিয়ানির  ব্যবস্থা হবে নাকি বাটার চিকেন?"

"Facebook এ countdown এ আজকে মেনু লাগাও, কবে যেন চিংড়ি মাছের মালাইকারি?"
........
.......
.......

"The next stop is Parijsplein. Do not forget to use your OV chipcard after your stop has been announced......."

পুজো শেষ।
আজকে ট্রাম অফিস শান্ত। ফোন বাজছে না ।

আমার পাশের ডাচ ভদ্রলোক (মুখ চেনা হয়ে গেছে) বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছেন ।
এই বুঝি জিজ্ঞেস করেই ফেলবেন ...
"দূর্গা পুজো শেষ?'

ps: All characters appearing in this work are fictitious. Any resemblance to real persons, living or dead, is purely coincidental.
;-)