Thursday 26 August 2021

বই পোকা


আজ অনেকদিন বাদে একটু হিজিবিজি লিখতে ইচ্ছে করলো । 
একটা বাংলা বই পড়তে পড়তে স্মৃতির কোণায় কিছু ঘটনা উঁকি ঝুঁকি দিলো বলে বোধহয় ..
বাংলা বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিলো তিনটি প্রধান সূত্র থেকে ।

১. হাই স্কুলের বাংলা টিচার :  
ব্যাকরণটা একদমই ভালো লাগতো না জুনিয়ার স্কুলে। ওই সব সন্ধি-ফন্ধি, কারক-ফারক, সমাস-ফমাস। কোনোরকমে মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস্ নম্বর আনার জন্য পড়তাম। সত্যি বলতে কি, কান ঘেঁষে পাস  করতাম প্রত্যেকবার। হাতের লেখাটা ভাল ছিলো, হয়তো বা দু-এক নম্বর neatness এ দিয়ে পাস করিয়ে দিতেন মিসরা । সে যাগ্গে, এখন ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। বাংলা ভালো লাগতে শুরু করলো ক্লাস ৮ থেকে। ভালো  লাগার কারণ দুই বাংলা মিস। মিস মিত্র আর মিসেস চৌধুরী । দুজনে হাতে কলমে বাংলা ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। সন্ধি-কারক-সমাসের উর্দ্ধে মনের ভাব কি ভাবে প্রকাশ করে আনন্দ পাওয়া যায় তাই শিখিয়েছিলেন । বাংলা লিখে ও পড়ে আনন্দ পেতে শিখিয়েছিলেন । ইংলিশ বইয়ের পোকা বরাবরই ছিলাম কিন্তু ওনারা বাংলা বইয়ের পোকা করে দিয়েছিলেন। স্কুলের বাংলা বইয়ের ছোট্ট লাইব্রেরিটা হয়ে উঠেছিল এক বিরাট আকর্ষণ। শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের লাল রঙের অমনিবাস হয়ে উঠেছিল নিত্যসঙ্গী!  কখনো ফিজিক্স বইয়ের ভেতর লুকিয়ে, আবার কখনো লেপের তলায় টর্চ জেলে। 
বইপোকা!

২. জেঠতুতো দিদি : 
দিদি আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সব থেকে গুণী । পড়াশোনায় যেমন ভালো আবার তেমনি গল্পের বইয়ের পোকা । কিন্তু ওই পড়াশোনায় ভালো বলে সাত খুন মাফ - কেউ কিছু বলতোনা - সে যতই গল্পের বই পড়ুক। আমি বরাবরই দিদির খুব ন্যাওটা, আবার খুব বন্ধুও । প্রত্যেক বছর যখন জামশেদপুর যেতাম গরমের বা পুজোর ছুটিতে, তখন দিদির সাথে পাড়ার ক্লাবের লাইব্রেরি যেতাম ।  নিয়মকরে প্রায় রোজ সন্ধেবেলা । লাইব্রেরিয়ান কাকু দিদিকে দেখলেই বলতেন "আর নতুন কিছু বই নেই তোকে দেবার, সবই তো তোর পড়া !!"। সেটা শুনে  আমার খুব মজা লাগতো । আমার তখন বাংলা বইয়ের প্রতি তেমন আকর্ষণ নেই । দিদি দুপুর বেলা বই পড়তো শুয়ে শুয়ে । আসতে আসতে আমার হাতেও দু একটা উপন্যাস ধরাতে লাগলো । কোনটা প্রেমের গল্প, কোনটা ডিটেক্টিভ রহস্য, কোনটা ভ্রমণকাহিনী   -- 'বড়দের' লাইব্রেরি থেকে 'বড়দের' বই!  সে এক দারুন  উত্তেজনা । অনেক লেখকের সাথে আলাপ করালো দিদি,  গরমের দুপুরে বিছানায় গড়িয়ে গড়িয়ে বাংলা গল্পের বই পড়ার আনন্দ অনুভব করালো । সে অভ্যেস টিকে গেলো। বইপোকা!

৩. মাসি :  
আমার খুব ঘনিষ্ট বান্ধবীর মা । আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন । মাসির বাড়িতে আলমারিটা ছিল একটা ছোট খাটো লাইব্রেরি । বাংলা বই এ ঠাসা । কস্তুরী আর আমি একসাথে টিউশন পড়তে যেতাম। যাবার পথে ওকে ডাকতে গিয়ে টুক করে একবার আলমারির সামনে দাঁড়াতাম । কোন বইটা? কোন বইটা? চাইবো?  কোনটা চাইবো? বাড়ি নিয়ে যাবো বইটা? মা আবার বকবে নাতো? মাথায় হাজার প্রশ্ন।
এমনি একদিন মাসি জিজ্ঞেস করলো , "সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'প্রথম আলো' পড়েছিস?" । বললাম , না পড়িনি । মাসি আলমারি থেকে বার করে হাতে দিলো প্রথম আলোর দুটো খন্ড ।প্রচন্ড ভালো লেগেছিলো । যেন মনের একটা জানলা খুলে গেছিলো । তারপর থেকে প্রচুর বই পড়েছি ওই আলমারি থেকে। কিন্তু মনের কোনায় সেই দিন থেকে  "প্রথম আলো" গেঁথে আছে কিছুভাবে । মাসি আজ নেই কিন্তু আমার জীবনে  মাসি আর মাসির বইয়ের আলমারির বিশাল অবদান। বইপোকা!

সময় বদলেছে, আমার জীবন ও হঠাৎ করে একদম বদলে গেছে ।

আজ অনেকদিন বাদে হাতে 'প্রথম আলো ' বইটা তুলে নিয়েছি । কয়েক পাতা পড়েই মন চলে গেলো অতীতে ।বাংলা মিস, জেঠতুতো দিদি আর মাসিকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম । ভাগ্গিশ আমাকে 'বইপোকা' বানিয়েছিলো।......

জীবনের যে কোনো  সময়ে  বইয়ের মতন ভালো বন্ধু আর হয়না ।