Tuesday 15 September 2015

আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে



হল্যান্ড -এর আকাশে ঘন কালো মেঘ । সাথে বেশ ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া । সুজ্জিমামার পাত্তাই নেই। না আছে কাশ ফুলের মাঠ, না আছে শিউলি ফুলের গন্ধ । না আছে পাড়ার প্যান্ডেল বাঁধার তোড়জোড়। না আছে পুজোর বাজারের রমরমা । তবু যে কেন মনটা পুজো পুজো করছে কে জানে । ক্যালেন্ডার এর দিকে তাকালেই কেন যে মাথার মধ্যে দিন গোনা শুরু হয়ে যাছে বুঝতে পারছি না । ষষ্ঠী আর ৩২ দিন বাকি ।
আসলে যখন হল্যান্ড এ পুজো হতো না, তখন এতটা পুজো মিস করার গল্প ছিল না । কেমন জানি একটা হালছাড়া "সবই ভাগ্য" বলে মেনে নিয়েছিলাম। পুজো মিস করাটাও কেমন জানি অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো। অনেকে যেতো পুজো দেখতে Koln. আমরাও একবার Frankfurt গেছিলাম পুজো দেখতে, ইন্দ্র্দার বাড়ি। খুব ভালো লেগেছিল । 
তারপর ৫ বছর আগে হুজুগ তুলে দূর্গা পুজো শুরু করা হলো হল্যান্ড এ । এখন সেই পুজো ছেড়ে আমি কলকাতার পুজো দেখতে যেতেও রাজি নই আর । এ যেন আমাদের বাড়ির পুজো ।"কল্লোল" এর পরিবারের পুজো । এমন লাগে পুজোর চারটে দিন যেন এই পুজো দেখেই আমি বড় হয়েছি।
এতই আপন, এতই নিজের । 
বাঙালির উত্সাহ জগত বিখ্যাত ।কুমোরটুলি থেকে মা দুগ্গা & family নিয়ে এসে হাজির করলো হল্যান্ড এর মাটিতে । সঙ্গে এলো ঢাক ,পঞ্চপ্রদীপ, কাঁসর ঘন্টা, শাঁখ এবং আরো অনেক জিনিস যা এখানে পাওয়া মুশকিল । এবার খুঁজে বার করা হলো একটি হল, এখানে তো প্যান্ডেল বানানো সম্ভব নয়। হলের লোকজনকে বসিয়ে বোঝানো হলো দুর্গাপুজোর মানে। মুখে বোঝানো আর নিজের চোখে দেখা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস,। হলের কর্মর্কর্তারা যখন নিজের চোখে দেখলেন  তখন তো তাদের চক্ষু ছানাবড়া! 
এত লোক? এত খাবার? এত পুজো? এত আওয়াজ ? এত সাজ? এত গান? এত নাচ?
হোম যজ্ঞ দেখে তো তাদের fire brigade ডাকার অবস্থা! তবে গত ৫ বছর পুজো দেখার পর আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে হলের Wesley নামক ডাচ ছেলেটি এবার অষ্টমীতে আমাদের সাথে অঞ্জলি দেবে চোখ বুজে হাত জোড় করে !!
আমাদের পুজো হয় চারদিন ধরে -ঠিক ইন্ডিয়ার মতন । বিদেশে বেশির ভাগ জায়গায় পুজো হয় উইকেন্ডে , শনি রবিবারের ছুটির সুবিধে নিয়ে । 
এখানের স্কুলে ছুটি থাকে না। ..তাই বাচ্ছারা আসে বিকেলবেলা । আমাদের ছেলেমেয়েরা দুর্গাপূজো কতটা বোঝে জানি না তবে এই একসাথে হবার মজাটা খুব উপভোগ করে । আমার দশ বছরের ছেলে পুজোর হল এ যায় বন্ধুদের সাথে খেলতে। এক বয়সের অনেকগুলো বাচ্ছা সারা বিকেলে ipad এ খেলে কাটিয়ে দেয়। হলে একটা ছোট্ট কাউন্টার এ  ড্রিঙ্কস এবং চিপস পাওয়া যায়। ছেলের হাতে ৫ ইউরো দিয়ে রাখি।..খুব খুশি হয়, ইচ্ছে মতন চিপস আর কোলা কিনে খেতে পারে বোলে ।
আমার মনে পড়ে যায় আমার ছোটবেলার কথা । জামশেদপুরে বাড়ির পাশেই পুজো। সারা বছর অপেক্ষা। ..স্কুল ছুটি হলেই পরের দিন বাসে চেপে জামশেদপুর। জ্যাঠতুতো দুই বোন আর এক দাদা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত আমাদের টেম্পোর অপেক্ষায়। এক ছুট্টে আসত। আমি আর ভাই মিলে ৫ জন।টেম্পো থেকে নেমেই বাড়ি না ঢুকে সোজা পুজোর জায়গায়। ঠাকুরের তখন চোখ আঁকা হচ্ছে কিম্বা ঘাম তেল লাগানো হচ্ছে, বাংলায় যাকে বলে ফিনিশিং টাচ!। খুব ভালো লাগত দেখতে। তারপর বাড়ি গিয়ে খেয়ে দেয়ে উঠেই মা সুটকেস খুলত আর জেম্মা আলমারি। নতুন জামাকাপড় দেখাবার পালা । আমাদের তিন্ বোনের জন্য একরকমের জামা বানাতো মা, আবার এক রকম জামা বানাত জেম্মাও । ছোটমামা ইয়ার্কি মেরে বলতো, "থান কিনে পর্দা আর মেয়েদের জামা বানিয়েছে"।  একটু দুরেই আমার মামাবাড়ি। বিকেলে সেখানে গিয়ে সবার সাথে দেখা কোরে খানিকক্ষণ আড্ডা মেরে আসতাম ।
পুজোর দিনগুলো সকালে চান সেরে নতুন জামা পড়ে পুজো প্যান্ডেলে যেতাম।সাথে একটা পার্সে টাকা। এক এক দিন এক এক জনের পালা টাকা দেবার। কোনদিন ঠাকুমা, কোনদিন জেঠু, কোনদিন বাপি, কোনদিন পিসি, কোনদিন মামাবাড়ি। সে এক দারুন আনন্দের ব্যাপার--নিজের খুশি মতন সেই টাকা খরচ করা। আমরা চার ভাইবোন ১০ টাকা কোরে পেলে, ভাই পেতো ৫, অনেকটা ছোট ছিলো বোলে! সেই টাকাটা আবার ও ভরসা করে কেবল মাত্র জেঠুকে রাখতে দিতো। জেঠু "বুড়ো" বলতে অজ্ঞান, সেইটা ভাঙিয়ে ভাই দিনের শেষে ৫ কেনো, ২৫ টাকা উঠিয়ে নিতো জেঠুর থেকে !!!
আমরা তিন বোন আরো অনেক বন্ধু নিয়ে পুজো প্যান্ডেলে বসতাম, খুব আড্ডা হতো । মাঝে মাঝে উঠে নয় ফুচকা, নয় এগরোল, নয় মোগলাই খাওয়া হতো । ফুচকাওয়ালার সাথে "এক টাকায় চারটে কেন, পাঁচটা নয়"..এই ঝগড়া গুলোর মজাই আলাদা ছিলো ।কখনো কখনো আবার বেশ একটা "দিদি দিদি" ভাব নিয়ে মামাত-মাসতুতো ভাইদের নিজের পয়সা থেকে বেলুন কিনে দিতাম --দারুন একটা গম্ভীর ফিলিং ।
বিকেলে আবার অন্য জামা ।অষ্টমীতে মায়ের থেকে নেওয়া একটা শাড়ি, মায়েরই ব্লাউস টেকে পড়তাম ---উফ কি excitement !
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ির বারান্দায় সবাই মিলে বসতাম। তখনও  প্যান্ডেলে লোকের ভিড়। ঝলমলে আলো  চারিদিকে । আমরা  সবাই মিলে লোক দেখতাম। ..তবে একটু বেশি রাত হলেই বাপি "রাত হয়ে গেছে, শুয়ে পড়ো, কাল সকালে এ ওঠা আছে" বোলে আড্ডা ভঙ্গ করে দিতো । "কাকুর" ওপর কারুর কথা বলার সাহস ছিল না। .
;-)
দশমীর দিন খুব মন খারাপ লাগতো । সব থেকে কষ্ট লাগত যখন প্যান্ডেলটা খোলা হতো । রঙিন ঝকঝকে কাপড় সরে গিয়ে শুধু মাত্র বাঁশ গুলো দাড়িয়ে থাকত। মনে পড়ে যেত আর মাত্রকটা দিন পরেই দুর্গাপুর ফেরার পালা। থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর ! জেঠতুতো , মামাতুত , মাসতুতো  সব ভাইবোনদের ছেড়ে আবার নিজের জায়গায়।....
ঠাকুর ভাসান দিয়ে ফিরে হারুজেঠু শান্তি জল ছিটিয়ে দিতেন মাথায় ।সবাই "এই যে এদিকে এদিকে, আমরা পাইনি আমরা পাইনি" বলে আরো শান্তির দাবি করতো। তারপর সবাই দল বেঁধে আসতো আমাদের বাড়ি। ঢিপ ঢিপ প্রনাম আর কোলাকুলির পালা --সাথে প্লেটে ঘুগনি, মিহিদানা, নারকোলনাড়ু আর চানাচুর!! সেটা খেয়েই ছুটতাম মামাবাড়ি। সেখানে প্রনাম সেরেই দিদার বানানো লুচি আর আলুর দম। ওমনি আলুর দম আর কোনদিন কোথাও  খাইনি ! বিজয়া দশমী শেষ !

"মা মা,  আমার গিটার ক্লাস আছে, চলো "

ছেলের ডাকে চমকে উঠলাম। জামশেদপুর থেকে সোজা ফিরে এলাম  হল্যান্ড !
নাহ, যাই রেডি হই, ছেলের গিটার ক্লাস আছে..........................


Sunday 12 July 2015

স্মৃতির ফ্রেমে :বর্ষা এলো


















বর্ষাকালের প্রথম ছিঁটেয় মনটা উড়ু উড়ু
আকাশ জুড়ে মেঘের মাদল বাজছে গুরু গুরু !
কালো মেঘের দল যখন আকাশ ভারী করে,
গোমড়া মুখে গাল ফুলিয়ে তাকায় আমার পরে,
স্মৃতির টানে মন চলে যায় বহু বছর আগে,
হারিয়ে যাওয়া গল্প কত আবার মনে জাগে !

বৃষ্টি ভেজা সকালবেলা "rainy day"র আশা,
স্কুল বুঝি আজ ছুটি হবে, ভাবতে লাগে খাসা!
সে গুড়ে বালি,যেতেই হবে, স্কুল হবে না কামাই,
মা তাকায় কটমটিয়ে, নেই যে উপায় তাই !!
রেনকোটটা নতুন, গায়ে হাজার গোলাপ বুটি,
গাল ফুলিয়ে স্কুলের দিকে এগোই গুটি গুটি !!

ভিজে ভিজে এলো সবাই শুরু হলো ক্লাস ,
জানলা দিয়ে বাইরে দেখি, মন হয় উদাস।
হুমায়ুন নাকি বাবর, টিচার কিযে সব বলে, 
বাইরে দেখি চড়ুইখানা ভিজছে কেমন জলে !
স্কুল শেষের ঘন্টা বাজে, ফুটল মুখে হাসি ,
বাড়ি যাবার পথে আমি ভিজতে ভালবাসি !

রেনকোটটা ব্যাগের ভেতর ঢুকলো হয়ে ভাঁজ ,
ভিজব যদি আমি তবে ওটার কি আর কাজ?
বাড়ি ঢুকেই এমন জোরে পড়ল কখান হাঁচি
ভাগ্গিস মা রান্নাঘরে, না শুনতে পেলে বাঁচি !!
এমনিতেই মেজাজ গরম, কাপড় যেসব ভিজে, 
ঘরের ভেতর ঝুলছে তারা, স্যাঁতস্যাঁতে ভাব কিযে! 
বিকেলবেলা বৃষ্টি এলো এমন মুশল ধারে ,
খেলাধুলো উঠলো মাথায়, বসে সিড়ির পাড়ে,
পুরনো খাতার পাতা ছিঁড়ে নৌকো হলো গড়া
চলল সেটা দুলকি চালে ঘুড়তে পাশের পাড়া !
তারপর উঠলো জমে লুডো সন্ধেবেলা ,
বাবা কেবল গুটি সরায়, একি আজব খেলা !
ভাই রেগে খেলবে না আর, গুটি দিল সব ঘেঁটে 
গুড়গুড়িয়ে খিদের আগুন উঠলো জ্বলে পেটে !!

মা বানালো খিচুড়ি আর সাথে ডিমের ভাজা,
পাশে ইলিশ কড়া করে, সে যে মাছের রাজা!
ঝুপ করে তারই মাঝে লোডশেডিং-এর পালা 
বাদলা পোকা ধরল ঘিরে ওরে একি জালা !
টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে চোখ বুজে শুধু শুনি
বিদ্যুত আর বাজের মাঝে কতো সেকেন্ড গুনি !
জড়িয়ে আসে চোখ, মনের ভেতর আশা ,
কাল আবার 'rainy day', ভাবতে লাগে খাসা !





Photo courtsey:http://www.manillenials.com












Tuesday 7 July 2015

দাম্পত্য কলহ ৮:আমিও ভালো তুমিও ভালো



On Whatsapp/FB someone wrote: 
[I do not know the source, but giving due credit]
FB /Whatsapp  এ দেখে বসে থাকা গেল না....লিখেই ফেললাম উত্তর।.
Source তা জানা নেই.....But with all due credit ..যিনি প্রথম পার্টটা  লিখেছেন , তাকে।খুব সুন্দর হয়েছে ।


"দন্দ্বে দাপটে, খ্যাংরা-ঝাপটে জীবন বিষালে তুমি
জিহ্বার শিলে এ হৃদয় লয়ে মশলা পিষালে তুমি
শুনগো শালার ভগিনী আমার, শুন শ্বশুরের বেটি
আমি টেঁসে গেলে রবে কি হেঁসেলI চিতল মাছের পেটি?
উচ্ছে যেমন সুক্তোর বুকে তেমনি আমাতে তুমি
জীবনে আমার সেরা ব্লান্ডার তুমি শুধু তুমি।"

I [Dayeeta Roy] wrote back:

এত দন্দ , এত দাপট, এতই যদি বিষ,
আহাগো কর্তা, জীবন যদি এতই নিরামিষ,
বাপের বাড়ি আমি গেলে তবে কেন হয় দুর্দশা,
মনে পড়ে যায় চিতল মাছ নাকি মাংশ কষা?
শোনো দেওরের ভ্রাতা আমার, শোনো শাউরির ছানা,
আমাকে ছাড়া অকুল সাগরে পড়বে আছে যে জানা !
আমি টেঁসে গেলে চিতল কেন, জুটবে না আর ভাত,
আমি বিনা তুমি, হে প্রাণনাথ, একেবারে কুপোকাত ! 
তোমার শুক্তে জেনে রেখো প্রিয়, আমি হলাম ঘি,
জীবন তোমার সুগন্ধে এই আমিই ভরিয়েছি!!



Photo:www.pinterest.com


Monday 8 June 2015

Maggi পাঁচালি




[পাঠকদের কাছে অনুরোধ লক্ষী পাঁচালির মতন সুর করে পড়ুন।...]

ঘরে ঘরে হাহাকার, বুক ভরা ব্যথা,
শোন সবে বলি আজি  Maggi ব্রতকথা ।
যে জন পড়িবে  ব্রত দিয়া প্রাণ মন ,
অন্নপূর্ণা-র কৃপা দৃষ্টি পাইবে অনুক্ষণ !
অগাধ সুস্বাদু  Maggi আসিল জীবনে,
মর্তবাসী পড়িলো প্রেমে, নিশ্চিন্ত মনে ।
ভাত ডাল রাঁধিবার নাহি প্রয়োজন,
দুমিনিটে  Maggi হয়, খুশি জনগণ !
পিতামাতা রাগি কহেন খাও ভাত বসে,
শিশুগণ Maggi চায়, ফোলে গাল রোষে !
অতঃপর পিতামাতা মানিয়া নেন হার,
Maggi -র জিত হয়, অতি অবিচার ।
ঘরে ঘরে শুরু হয় Maggi-র জয় গান,
অবিদিত মর্তবাসী পুলকিত প্রাণ ।
দুমিনিটে Maggi রাঁধো সহজ উপায়,
ছেলে বুড়ো সকলেই খুশি মনে খায় !
হোস্টেলে Maggi যেন মায়ের আশির্বাদ,
ক্ষুদার্ত ছাত্রদের বন্ধ  আর্তনাদ।
ভোলাভালা প্রজাগণ রাখেনা খবর ,
জানেনা খুঁড়িছে  তারা নিজের কবর!
লক্ষিরে উপেক্ষা করি, ডাকিতেছে যম ,
স্বেচ্ছায় বিষ পান, হায় বুঝিতে অক্ষম !
ভেজাল খেয়ে বড় হয় মর্তবাসীর ছানা,
বিশুদ্ধ কাহারে কয় নেই তাদের জানা !

দৈবযোগে করিল টেস্ট কোনো সুধিজনে,
দুখী হলো  মর্তবাসী Maggi -র পতনে ।
Maggi তে যে ঠেসে ভরা ক্ষতিকর সীসা ,
শুনি সব গুনি জনে হারাইল দিশা!
ধনমদে মত্ত  Nestle করিয়াছে হেলা,
ঢালিয়াছে বিষ পেটে , অসাধু এ খেলা!
বুদ্ধিমান অমিতাভ ও পড়িলেন এ ফাঁদে ,
অলৌকিক Maggi খাইয়া জয়া দেবী কাঁদে !
মাধুরী মোহিনী তবুও জড়াইল কেস-এ,
খেয়েছিল এক বাটি বিজ্ঞাপনের শেষে!
গাল ভরা টোলে আজ ডুবিয়া  মিস জিনতা
এদিকে সিনেমা নেই তারওপর এই চিন্তা!
না জানিয়া শুনিয়া কেন করা বিজ্ঞাপন ?
অভিযুক্ত হলেন এরা, ঝামেলা অকারণ!
ভয়ে ভয়ে মর্ত হোতে বিদায় নিলো  Maggi ,
আবেগপ্রবণ মর্তবাসী হন গৃহত্যাগী  ।
Facebook এ স্নৃতিচারণ, সেকি হাহাকার,
Maggi প্রেমী মর্তবাসী করিছে প্রচার।
সুস্বাদু হইলেই তাহা হিতকর নয় ,
লোভ মোহ ত্যাগই হলো জীবনের জয় !
স্বাস্থকর খাইয়া ভালো থাকো ভক্তগণ,
অন্নতে ফিরে যাও, করো লক্ষীর  পূজন।
Maggi -র ব্রতকথা হইলো  সমাপন,
ভাত ডাল খেয়ে বাঁচো, জয় লক্ষীনারায়ণ !






Monday 16 March 2015

গ্রামের নাম ভগলপুর

আমাদের ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের নাম ভগলপুর ।
সরু সুরকি ঢালা রাস্তা চলে গেছে কোতুলপুরের বড় রাস্তা থেকে গ্রামের দিকে। দুই ধারে আলুর চাষ, মাটির বাড়ি আর বাঁশ গাছের ঝাড়।




ছোটবেলায় যখন যেতাম তখন কোনো সুরকি রাস্তা ছিল না। আমাদের গরুর গাড়ি গড়গড়িয়ে মাঠের আল, কাঁচা রাস্তা, নদীর ঢাল দিয়ে ছুটতো। ঝাঁকুনির ঠেলায় সারা গায়ে ব্যথা হয়ে যেতো। আমরা ভাইবোনরা ইয়ার্কি মেরে বলতাম দাদুর দাদু নিশ্চয় একটা হেলিকপ্টার এ করে এই অজ পাড়াগাঁ খুঁজে পেয়েছিলেন বাড়ি বানাবার জন্য। গ্রামে যেতাম বছর এ একবার। দোল এর সময়।আমাদের পরিবারের রাধা কৃষ্ণ মন্দির আছে।খুব  ধুমধাম করে দোল খেলা হয় আজ বহু বছর ধরে। শহরের দোল খেলা থেকে একদম আলাদা। নাচ আর গান এর তালে তালে রাধা আর কৃষ্ণ হোলি খেলেন আমাদের সবার সাথে। 
গ্রামে আমাদের মাটির দোতলা বাড়ি। গোবর লেপা উঠোন, খড়ের গালুই , ধানের ঢেঁকি, টিউব ওয়েল এর জল। সামনে পুকুর, বাঁশ ঝাড় আর ধানের খেত। খানিকটা হেঁটে গেলেই নদীর পার...আঁকা বাঁকা ...বালুর চর....একেবারে কবিতার বই থেকে তোলা দৃশ্য। সব মনে আছে ছবির মতন।




শহর থেকে গিয়ে সব থেকে কষ্ট হতো সকাল বেলা মাঠে যেতে। কিন্তু "nature's call", কোনো উপায় নেই। একটু বড় হবার পর সত্তি ভীষণ লজ্জা করত। এখন কিন্তু ভাবলে কেবল মজাটাই মনে পড়ে।  ভোরবেলা সব মেয়েরা মিলে এক সাথে "mission মাঠে যাওয়া"। মা আর জেঠিমা তো মাঠে বসে গল্পও জুড়ে দিতো।  
"দিদি, কাজের মেয়েটা খুব ঝামেলা করছে, এত কামাই ভালো লাগে না" ... 
"আর বোলো না আমাদেরটা তো পুজোয় আবার pure সিল্ক  শাড়ি চেয়েছে".. এমন ভাবে গল্প করত যেন আমরা বাঁশঝাড়ে বসে নেই, নিজের শহরের বাড়ির বসার ঘরে বসে আছি ! এখন মনে পড়লে হাসি পায়, ভেবে পাইনা কি করে যেতাম মাঠে।সব ভাইবোনেরা মিলে নদীতে চান করা, ফিরে এসে শালপাতার থালায় ভাত, ডাল, পোস্ত মেখে খাওয়া,উঠোনে মাদুর পেতে রোদে পিঠ দিয়ে বসে গল্প করা। ..এখন ভাবলে স্বপ্ন মনে হয় ।
সন্ধেবেলা টিনের বাটিতে মুড়ি আর আলুর চপ খাওয়া হতো । সেই চপ আবার দোলের মেলাতলা থেকে কেনা। সাথে রোবে-কাকার বাউল গান। হ্যাজাকের আলোয় বড় বড় ছায়া, ভিনভিন করে উড়ছে কিছু মশা, দুরের মাঠে ঝিঝি পোকার এক টানা আওয়াজ। রাতের খাওয়া সেরে মাটির সরু সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় শুতে যেতাম আমরা ভাইবোনেরা। দারুন মজার ব্যাপার।.এর মাঝে কেউ একটা ভুতের গল্প শুরু করলে আর ঘুম আসত না। আবার বেশিক্ষণ জেগে থাকার উপায় ও ছিল না। পরের দিন দোল, অনেক কাজ !




গ্রামে মাছ খাওয়ার বড় সুখ। পুকুর থেকে মাছ তুলে তখনি সেটাকে পরিষ্কার করে কেটে কুটে গরম তেলে ভেজে শাল পাতায় করে খাওয়ার যে কি মজা তা বলে বা লিখে বোঝাতে পারব না । কি স্বাদ , কি রূপ, লিখতে গিয়েই জিভে জল চলে আসছে। আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা পুকুর পাড়ে মাছ ধরা দেখতাম, তারপর সেই মাছ মুচমুচে করে রেবী পিসি ভেজে খাওয়াতো । অপূর্ব! কোথায় লাগে Michelin Star -এর টেস্ট !!





জীবনের নানা কাজের চাপে  গ্রামে যাওয়া হয়নি বহুদিন। আজ প্রায় ২০ বছর বাদে মন এমন টানলো যে এক সপ্তাহের মধ্যে টিকিট কেটে সবাইকে চমকে দিয়ে পৌছে গেলাম ভগলপুর। গত কয়েক বছর অনেক গল্প শুনেছি মা বাবার কাছে --গ্রাম কত বদলে গেছে । ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে পৌছলাম গ্রামে।
সত্তি সেই গ্রাম আর নেই। কোথায় সেই আল আর বাঁশ ঝাড় ? সুরকির রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে গাড়ি ছুটল। কলকাতা থেকে গাড়ি সোজা গিয়ে থামল একেবারে বাড়ির সামনে। একটু আধটু ঝাঁকুনি লাগলো ঠিকই তবে কোথায় লাগে সেই গরুর গাড়ির দুলুনি? মাটির বাড়ি কিছু আছে ঠিকই তবে বেশ কিছু বড় পাকা বাড়ি তৈরী হয়েছে।বাড়িতে ঢুকেই দেখি লাইট, পাখা, কলে জল, পাকা বাথরুম। অবাক হবার পালা আমার।..একদিকে যেমন গ্রামের উন্নতি দেখে মন ভরে গেল, আবার অন্যদিকে কেমন জানি একটা নিরাশা।  আসলে এটা nostalgia ...কুড়ি বছর আগের স্মৃতির সাথে না মেলাতে পারার নিরাশা! তাছাড়া এবার কোনো ভাইবোন আসতে পারেনি , ওদের ছাড়া গ্রাম যেন সেই গ্রাম না ।
নেমেই ব্যাগ রেখে বেরোলাম হাঁটতে।কিছু জিনিস একটুও বদলায়নি। দোলতলার সেই বড় গাছটা আজ ও দাঁড়িয়ে, তার সামনের টিউব ওয়েল আজ ও আছে । আমরা ছোটবেলায় toothbrush নিয়ে ওই টিউব ওয়েল এর সামনে লাইন করে মুখ ধুতাম ।পাশের পুকুরটাতে আজ ও অনেক হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে ঘুরে বেড়াছে। মন্দির এর পাশের পুকুরটা অবশ্য একদম শুকিয়ে গেছে।পাশ দিয়ে সরু রাস্তা গেছে মন্দির এর দিকে। দুই পাশে কয়েকটা পাকা বাড়ি হয়েছে  যেগুলো আগে ছিল না । ভাঙ্গা মন্দির ও সারানো হয়েছে ।
নানা পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে নদীর দিকে হাঁটা দিলাম । সাথে  কামেরার শাটার এর কিল্ক ক্লিক শব্দ!















এই ছোট্ট গ্রামের দোল বড় সুন্দর । মন্দির থেকে বেরিয়ে দোল মঞ্চে এসে রাধা কৃষ্ণ আমাদের সাথে দোল খেলেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে গ্রামের পুরুষেরা, মেয়েরা পরে হলুদ শাড়ি। ঠাকুরকে কোলে তুলে নেওয়া হয় গানের ছন্দে। নাচের তালে তালে রাধা আবির মাখিয়ে দেন কৃষ্ণকে, কৃষ্ণ রাধাকে। আবিরে  রাঙ্গা হয়ে ওঠে দোল মঞ্চ।খোল করতাল ঢাক বাজিয়ে গান গাওয়া হয়। আমরা মেতে উঠি বসন্তের আনন্দে ।
"আজ হলি খেলব শ্যাম তোমার সনে, একলা পেয়েছি তোমায় নিধু বনে "
কিম্বা,
"আবিরেতে অঙ্গ মাখা, কালো অঙ্গ গেছে ঢাকা, তুমি বংশীধারি, তাই তো তোমায় চেনা যায় "













সারাদিন দোল খেলার পর ঠাকুর ফেরেন মন্দিরে । আমরাও গুটি গুটি পায়ে বাড়ি ফিরি । আগের সেই নদীর স্নানের মজা আর নেই, বাড়িতে যে এখন কল খুললেই জল ! পাকা বাথরুম এ স্নান করতে করতে মন কিন্তু চলে যাছিল সেই কুড়ি বছর আগের নদীতে। সবাই মিলে নামতাম। তখন তো সাঁতার ও জানতাম না। ..কিন্তু কি মজাই না হতো ।গামছা দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা, বালি খুঁড়ে জল বার করার চেষ্টা , গ্রামের মেয়েদের ডুব সাঁতার দেখে আনন্দে হাততালি দেওয়া  ...আরো কত কিছু। নদীর জলে দুতিন ঘন্টা কাটিয়ে যখন বাড়ি আসতাম, পেটে তখন ভীষণ খিদে । দালানে মাটিতে বসে সবাই ভাত খেতাম , চোখ জুড়িয়ে আসত  ঘুমে আর ক্লান্তিতে । বিকেলে মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি , তারপর আবার খানিক্ষণ আবির খেলা। সারাদিন কত আড্ডা , কত মজা !

কুড়ি বছর অনেকটা সময় । লাইট পাখা বদলেছে ঠিকই তবে কিছু জিনিস ঠিক আগের মতন ।
এত বছর পরেও  রেবী পিসি চোখ ছলছল করে জড়িয়ে ধরল।
বলল "এত বছর পরে এলি ক্যানে? আমাদের জন্য মন খারাপ করে নাই? জামাইটারে, নাতিটারে আনলি না ক্যানে?"। তারপর নিজের হাতে বানিয়ে মুচমুচে মাছ ভাজা খাওয়ালো। দীর্ঘ কুড়ি বছর পরে দেখা হলো। বয়স বেড়েছে আমার, রেবী পিসির  --দুজনেরই । কিন্তু সম্পর্ক যেন ঠিক আগের মতন। একটুও  বদলায় নি।খুব ভালো লাগলো ।
একটা ছোট্ট ছেলের সাথে আলাপ হলো। নাম অরিত্র । এমন "মাসি মাসি " করে জড়িয়ে ধরল যেন কত চেনা । খুব মায়া পরে গেল দুদিনেই ছেলেটার ওপর । কেন জানি বার বার মনে হলো যে গ্রামের লোকেদের ফীলিংস খুব "জেনুইন " একেবারে অকৃত্তিম!
ভালো লাগলো দেখে যে গ্রামের স্কুলটা  কত বড় হয়ে গেছে । অনেক ছেলে মেয়ে পড়াশোনা করছে । ছোট ছোট মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুল  যাছে ।গ্রামে একটা dispensary খুলেছে। ঘরে ঘরে পাকা toilet হয়েছে ।লাইট জ্বলছে, পাখা চলছে। গ্রামের অনেক লোকের হাতে মোবাইল ফোন।  উন্নতি হয়েছে প্রচুর।

না, এবার মাঠে যেতে হয়নি । সুন্দর ঝকঝকে toilet । আবার ওয়েস্টার্ন স্টাইল । কনসেপ্টটা "attached বাথরুম" -এর কিন্তু বাড়ি থেকে দুই পা দুরে । নিরিবিলি, কোকিলের ডাক ,তাল গাছের পাতার সরসর আওয়াজ! ।
Nature's  call indeed !




খুব আনন্দ করে এলাম। তিনদিন ছিলাম কিন্তু একবারের জন্য মনে হলো না যে কুড়ি বছর পর গেছি ।
যেন এই তো সেদিন   ........
প্লেন যখন হল্যান্ড এর মাটি ছুঁলো, মনে হলো একটা অন্য জগত থেকে ফিরলাম ।
কাল সোমবার । অফিস আছে, স্কুল আছে   .....ভগলপুর অনেক দুরে।......




[ফটোগ্রাফারদের ধন্যবাদ।....]