Sunday 22 October 2017

জাপান কাহিনী ৪ :পুলিশ!! পালাও!!


জাপান এর কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে । মনে হয় যেন আগের জন্মের কথা ।
(জাপান কাহিনী ১ , ২,৩  প্রকাশিত)

আসলে জীবনের নানা ঘটনার সাথে নানা স্মৃতি জড়িত থাকে। সুযোগ সুবিধে বুঝে সেই স্মৃতি আবার উঁকি মারে। এমনি এক লুকোনো স্মৃতি হঠাৎ উঁকি মারলো দুর্গাপুজোর সময়, ভাবলাম লিখে ফেলি।

২০১৭। সেপ্টেম্বর মাস ।
হল্যান্ডে বসে অষ্টমীর দিন ভোগ খাচ্ছিলাম । কি অপূর্ব স্বাদ, গোবিন্দভোগ চালের গন্ধ, পুজোর আমেজ। মন চলে গেলো বেশ কিছু বছর আগের এক ঘটনায় ।
না ছিল পুজো,না ছিল ভোগ, না ছিল গোবিন্দভোগ চাল   .......

Kobe   (pc :www.jnto.go.jp)


১৯৯৬। অক্টোবর মাস । এক মাস হলো জাপান এ এসেছি ।
এমনিতেই হোম সিকনেস তুঙ্গে, তারওপর আবার দুর্গাপুজো!
যতবার ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাই মনটা খারাপ হয়ে যায়..........

আমাদের International hostel টা  Kobe পোর্ট এর খুব কাছে ছিল । হঠাৎ সেদিন জানা গেলো যে Kobe পোর্টে একটি ভারতীয় জাহাজ এসেছে। এক মহারাস্ট্রিয়ান স্টুডেন্ট এই খবরটা এনে দিলো। সাথে এও  বললো যে ওর এক বন্ধু জাহাজে চাকরি করে এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন নাকি বাঙালি, Mr. Roy, জিজ্ঞেস করছিলেন এখানে কোনো বাঙালিকে ও চেনে কিনা।

একে বাঙালি ক্যাপ্টেন , তারওপর Roy, তারওপর দুর্গাপুজো, সেদিন ছিল মহাষ্টমী!
শোনামাত্র হোমসিকনেস ছাপিয়ে উঠলো, মন কেঁদে উঠলো একটু বাংলা বলার জন্য, জেগে উঠলো বিদেশে দেশোয়ালি প্রেম।
যদিও ততদিনে হোস্টেলে দুই বাঙালি দাদা (A-দা , K-দা ) থাকাতে  বাংলা বলার সুযোগের কোনো অভাব ছিলোনা .....তবুও  ......

জাহাজের সমস্ত ডিটেলস নিয়ে আমি আর K -দা পৌঁছে গেলাম পোর্ট এ । কমন বন্ধুর সাথে আলাপ করে পৌঁছে গেলাম জাহাজে। কি বিশাল জাহাজ (নামটা ভুলে গেছি)। আমি জীবনে অত বড় জাহাজে আগে উঠিনি । ক্যাপ্টেন ছিলেন না বলে আমাদের অন্য একজন পুরো জাহাজ ঘুরিয়ে দেখালেন। নিচের ডেকে কত লোকজন, অনেকের সাথে আলাপ ও হলো। ওপরের ডেকে বসে চা খেলাম, অপেক্ষা করতে লাগলাম ক্যাপ্টেনের জন্য! জাহাজের বেশিরভাগ লোকজন দক্ষিণ ভারতীয়, তাই "আজ অষ্টমী" ফিলিংটা  তখনও ঠিক আসছিলো না ।
একটু পরে ক্যাপ্টেন ফিরে এলেন, আমাদের ডাকলেন ওনার কেবিনে । সাথে ওনার স্ত্রী ও  তিন বছরের মেয়ে। এইবার বেশ ভালো লাগলো। বাংলায় কথা বলতে পেরে মন খুশি হলো।

প্রথম দেশের বাইরে গেছি, মহাষ্টমীর দিন এক বাঙালি পরিবারের সাথে সুদূর জাপানে বসে গল্প করার যে কি আনন্দ তা লিখে বোঝানো যাবে না ।ওনারাও বার বার বললেন "আজ অষ্টমী, দেশের বাইরে ভালো লাগে না, ইত্যাদি ইত্যাদি।"
সমব্যথী পেয়ে মন আরো খুশি !

খাওয়া দাওয়া হলো, এবার হোস্টেলে ফেরার পালা।
ক্যাপ্টেন Roy বললেন, "তোমরা স্টুডেন্ট, আজকে পুজোর দিনে, কিছুই দিতে পারছি না তোমাদের। তবে ভালো গোবিন্দভোগ চাল আছে, তোমরা কিছু মনে না করলে আমি দিতে চাই "।

আমার সত্যি স্টুডেন্ট মানুষ । জাপানে এ বসে গোবিন্দভোগ চাল পাবার আনন্দে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়  নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। ক্যাপ্টেন পরিবারকে অসংখ ধন্যবাদ জানিয়ে গোবিন্দভোগ চালের প্যাকেট হাতে নিয়ে খিচুড়ি আর পায়েসের স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি আর K-দা হোস্টেলের দিকে হাঁটা দিলাম!

পোর্ট থেকে বেরিয়ে গোটা ১০মিটার গেছি।.....ব্যাস।...
হটাৎ সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি। ঠিক যেন হলিউড সিনেমার সিন্।
আমাদের দুজনকে ঘিরে  তিনটে পুলিশ গাড়ি এসে দাঁড়ালো ।
ব্রেকের আওয়াজ  ...ক্যাঁচ ক্যাঁ.......চ !!!
ভয়ে আমরা স্ট্যাচু !

বন্ধুকধারী দুই পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে জাপানিতে  কি যে বললো চিৎকার করে কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে কথার সুর এবং মাত্রা শুনে মনে হলো না ভালো কিছু বলছে। তাকিয়ে থাকলাম ফ্যাল ফ্যাল করে.....তখন একমাস ও হয়নি জাপানে। ভাষাটা একেবারেই বুঝিনা।
ওদের মধ্যে একজন আমাকে হাত তুলে ইশারায় কি যেন বললো। তাও বুঝলাম না।
এক পা নড়তেই একজন পুলিশ এক ছুট্টে একদম আমার কাছে। ততক্ষনে  তো আমার অবস্থা ঘাবড়ে ঘ। খেয়েছে , গ্রেফতার করবে নাকি? কি করলাম? K -দার ও একই অবস্থা ।
কেলেঙ্কারি কান্ড!

আমার ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে পুলিশ বাবাজি আরেকটু এগিয়ে এলো......আমি তখন আমতা আমতা করে বললাম, "actually we are  university students, we came to meet a friend..'
উনি কিছু বুললেন না, পাশের গাড়ি থেকে আরেক পুলিশকে ডাকলেন ।তার মনে হয় ইংরিজি সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ ছিল । তার ও হাতে বন্দুক!
সে চালের প্যাকেটটা  দেখিয়ে বললো "what in packet? down down"
[আমি ততক্ষনে ভয়ে চালের প্যাকেট এমন জাপ্টে ধরে আছি যেন প্রাণ গেলেও চাল যেতে দেব না]

নামিয়ে রাখলাম মাটিতে।....খুলে দেখালাম, বললাম,
"Rice, gift from captain, ship , India"
[ততদিনে বুঝে গেছি জাপানে কি করে ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে কথা বলতে হয়]

পুলিশ বাবাজি এমন ছিটকে উঠলো যেন প্যাকেট এ চাল নয় কেউটে সাপ দেখেছে।
বললো "Rice! Rice! no allowed!! port customs!, go back go back"

আমাদের তখন "ছেড়ে দেমা  কেঁদে বাঁচি " অবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে চালের প্যাকেট এগিয়ে দিলাম পুলিশের  দিকে।উনি এক পা পিছিয়ে গেলেন। জাপানিতে আবার কি সব বললেন, সুর এবং মাত্রা উঁচু!
পাশের ইংরিজি সেকন্ড ল্যাংগুয়েজ পুলিশ এগিয়ে এসে বললো  "no no, you go you go ..rice back "

"K-দা, মনে হচ্ছে বলছে নিজেদের গিয়ে ফেরত দিতে হবে"......

গুটি গুটি পায়ে ফিরলাম পোর্ট গেটে । কোনোরকমে চালের প্যাকেট পোর্ট এর অফিসে ফেরত দিলাম।অফিসার গেস্ট রেজিস্টারে নাম চেক করে বললেন, "Call Captain Roy? help?"

আমরা তখন কোনো রকমে হোস্টেলে ফিরতে পারলে বাঁচি ! চুলোয় যাক গোবিন্দভোগ চাল।
বরং গোবিন্দকে ডাকছি , হে ভগবান রক্ষে করো, বাঁচাও এই বিপদ থেকে!
"আরিগাতো আরিগাতো " বলতে বলতে একদম about turn !
[একটাই ওয়ার্ড শিখেছিলাম ততদিনে, আরিগাতো , মানে thank you ]

হোস্টেল ফিরে শুনলাম যে কিছু জিনিস পোর্ট এর বাইরে  নিয়ে যাওয়ার অনুমতি থাকেনা । চাল ও সেই লিস্টের একজন । ক্যাপ্টেন Royএর  নিজের হাতের সই করা অনুমতিপত্র থাকলে কোনো অসুবিধে হতো না । হয়তো বা তাড়াহুড়োতে উনি ভুলে গেছিলেন দিতে।
যাগ্গে, অষ্টমীতে খিচুড়ি বা পায়েস কোনোটাই খাওয়া হলো না। পুলিশের হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসার খুশি গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি খাওয়ার থেকে অনেক বেশি !

************************************~~~~~~~********************************

......দিন কাল পাল্টে গেছে । আজকাল সব কিছুই প্রায় পাওয়া যায় দেশের বাইরে । জীবনের চাহিদাগুলোর ও অনেক পরিবর্তন হয়েছে । সচেতনতা ও অনেক বেড়েছে ।
এখন কোনো স্টুডেন্ট অষ্টমীর দিনে এমনি ইমোশনাল হয়ে  পোর্টে গিয়ে গোবিন্দভোগ চাল নিয়ে আসবে বলে মনে হয় না.........
হয়তো Facebook এ স্টেটাস আপডেট দেবে "feeling emotional, missing gobindobhog chal"
;-)