Monday 16 March 2015

গ্রামের নাম ভগলপুর

আমাদের ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের নাম ভগলপুর ।
সরু সুরকি ঢালা রাস্তা চলে গেছে কোতুলপুরের বড় রাস্তা থেকে গ্রামের দিকে। দুই ধারে আলুর চাষ, মাটির বাড়ি আর বাঁশ গাছের ঝাড়।




ছোটবেলায় যখন যেতাম তখন কোনো সুরকি রাস্তা ছিল না। আমাদের গরুর গাড়ি গড়গড়িয়ে মাঠের আল, কাঁচা রাস্তা, নদীর ঢাল দিয়ে ছুটতো। ঝাঁকুনির ঠেলায় সারা গায়ে ব্যথা হয়ে যেতো। আমরা ভাইবোনরা ইয়ার্কি মেরে বলতাম দাদুর দাদু নিশ্চয় একটা হেলিকপ্টার এ করে এই অজ পাড়াগাঁ খুঁজে পেয়েছিলেন বাড়ি বানাবার জন্য। গ্রামে যেতাম বছর এ একবার। দোল এর সময়।আমাদের পরিবারের রাধা কৃষ্ণ মন্দির আছে।খুব  ধুমধাম করে দোল খেলা হয় আজ বহু বছর ধরে। শহরের দোল খেলা থেকে একদম আলাদা। নাচ আর গান এর তালে তালে রাধা আর কৃষ্ণ হোলি খেলেন আমাদের সবার সাথে। 
গ্রামে আমাদের মাটির দোতলা বাড়ি। গোবর লেপা উঠোন, খড়ের গালুই , ধানের ঢেঁকি, টিউব ওয়েল এর জল। সামনে পুকুর, বাঁশ ঝাড় আর ধানের খেত। খানিকটা হেঁটে গেলেই নদীর পার...আঁকা বাঁকা ...বালুর চর....একেবারে কবিতার বই থেকে তোলা দৃশ্য। সব মনে আছে ছবির মতন।




শহর থেকে গিয়ে সব থেকে কষ্ট হতো সকাল বেলা মাঠে যেতে। কিন্তু "nature's call", কোনো উপায় নেই। একটু বড় হবার পর সত্তি ভীষণ লজ্জা করত। এখন কিন্তু ভাবলে কেবল মজাটাই মনে পড়ে।  ভোরবেলা সব মেয়েরা মিলে এক সাথে "mission মাঠে যাওয়া"। মা আর জেঠিমা তো মাঠে বসে গল্পও জুড়ে দিতো।  
"দিদি, কাজের মেয়েটা খুব ঝামেলা করছে, এত কামাই ভালো লাগে না" ... 
"আর বোলো না আমাদেরটা তো পুজোয় আবার pure সিল্ক  শাড়ি চেয়েছে".. এমন ভাবে গল্প করত যেন আমরা বাঁশঝাড়ে বসে নেই, নিজের শহরের বাড়ির বসার ঘরে বসে আছি ! এখন মনে পড়লে হাসি পায়, ভেবে পাইনা কি করে যেতাম মাঠে।সব ভাইবোনেরা মিলে নদীতে চান করা, ফিরে এসে শালপাতার থালায় ভাত, ডাল, পোস্ত মেখে খাওয়া,উঠোনে মাদুর পেতে রোদে পিঠ দিয়ে বসে গল্প করা। ..এখন ভাবলে স্বপ্ন মনে হয় ।
সন্ধেবেলা টিনের বাটিতে মুড়ি আর আলুর চপ খাওয়া হতো । সেই চপ আবার দোলের মেলাতলা থেকে কেনা। সাথে রোবে-কাকার বাউল গান। হ্যাজাকের আলোয় বড় বড় ছায়া, ভিনভিন করে উড়ছে কিছু মশা, দুরের মাঠে ঝিঝি পোকার এক টানা আওয়াজ। রাতের খাওয়া সেরে মাটির সরু সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় শুতে যেতাম আমরা ভাইবোনেরা। দারুন মজার ব্যাপার।.এর মাঝে কেউ একটা ভুতের গল্প শুরু করলে আর ঘুম আসত না। আবার বেশিক্ষণ জেগে থাকার উপায় ও ছিল না। পরের দিন দোল, অনেক কাজ !




গ্রামে মাছ খাওয়ার বড় সুখ। পুকুর থেকে মাছ তুলে তখনি সেটাকে পরিষ্কার করে কেটে কুটে গরম তেলে ভেজে শাল পাতায় করে খাওয়ার যে কি মজা তা বলে বা লিখে বোঝাতে পারব না । কি স্বাদ , কি রূপ, লিখতে গিয়েই জিভে জল চলে আসছে। আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা পুকুর পাড়ে মাছ ধরা দেখতাম, তারপর সেই মাছ মুচমুচে করে রেবী পিসি ভেজে খাওয়াতো । অপূর্ব! কোথায় লাগে Michelin Star -এর টেস্ট !!





জীবনের নানা কাজের চাপে  গ্রামে যাওয়া হয়নি বহুদিন। আজ প্রায় ২০ বছর বাদে মন এমন টানলো যে এক সপ্তাহের মধ্যে টিকিট কেটে সবাইকে চমকে দিয়ে পৌছে গেলাম ভগলপুর। গত কয়েক বছর অনেক গল্প শুনেছি মা বাবার কাছে --গ্রাম কত বদলে গেছে । ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে পৌছলাম গ্রামে।
সত্তি সেই গ্রাম আর নেই। কোথায় সেই আল আর বাঁশ ঝাড় ? সুরকির রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে গাড়ি ছুটল। কলকাতা থেকে গাড়ি সোজা গিয়ে থামল একেবারে বাড়ির সামনে। একটু আধটু ঝাঁকুনি লাগলো ঠিকই তবে কোথায় লাগে সেই গরুর গাড়ির দুলুনি? মাটির বাড়ি কিছু আছে ঠিকই তবে বেশ কিছু বড় পাকা বাড়ি তৈরী হয়েছে।বাড়িতে ঢুকেই দেখি লাইট, পাখা, কলে জল, পাকা বাথরুম। অবাক হবার পালা আমার।..একদিকে যেমন গ্রামের উন্নতি দেখে মন ভরে গেল, আবার অন্যদিকে কেমন জানি একটা নিরাশা।  আসলে এটা nostalgia ...কুড়ি বছর আগের স্মৃতির সাথে না মেলাতে পারার নিরাশা! তাছাড়া এবার কোনো ভাইবোন আসতে পারেনি , ওদের ছাড়া গ্রাম যেন সেই গ্রাম না ।
নেমেই ব্যাগ রেখে বেরোলাম হাঁটতে।কিছু জিনিস একটুও বদলায়নি। দোলতলার সেই বড় গাছটা আজ ও দাঁড়িয়ে, তার সামনের টিউব ওয়েল আজ ও আছে । আমরা ছোটবেলায় toothbrush নিয়ে ওই টিউব ওয়েল এর সামনে লাইন করে মুখ ধুতাম ।পাশের পুকুরটাতে আজ ও অনেক হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে ঘুরে বেড়াছে। মন্দির এর পাশের পুকুরটা অবশ্য একদম শুকিয়ে গেছে।পাশ দিয়ে সরু রাস্তা গেছে মন্দির এর দিকে। দুই পাশে কয়েকটা পাকা বাড়ি হয়েছে  যেগুলো আগে ছিল না । ভাঙ্গা মন্দির ও সারানো হয়েছে ।
নানা পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে নদীর দিকে হাঁটা দিলাম । সাথে  কামেরার শাটার এর কিল্ক ক্লিক শব্দ!















এই ছোট্ট গ্রামের দোল বড় সুন্দর । মন্দির থেকে বেরিয়ে দোল মঞ্চে এসে রাধা কৃষ্ণ আমাদের সাথে দোল খেলেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে গ্রামের পুরুষেরা, মেয়েরা পরে হলুদ শাড়ি। ঠাকুরকে কোলে তুলে নেওয়া হয় গানের ছন্দে। নাচের তালে তালে রাধা আবির মাখিয়ে দেন কৃষ্ণকে, কৃষ্ণ রাধাকে। আবিরে  রাঙ্গা হয়ে ওঠে দোল মঞ্চ।খোল করতাল ঢাক বাজিয়ে গান গাওয়া হয়। আমরা মেতে উঠি বসন্তের আনন্দে ।
"আজ হলি খেলব শ্যাম তোমার সনে, একলা পেয়েছি তোমায় নিধু বনে "
কিম্বা,
"আবিরেতে অঙ্গ মাখা, কালো অঙ্গ গেছে ঢাকা, তুমি বংশীধারি, তাই তো তোমায় চেনা যায় "













সারাদিন দোল খেলার পর ঠাকুর ফেরেন মন্দিরে । আমরাও গুটি গুটি পায়ে বাড়ি ফিরি । আগের সেই নদীর স্নানের মজা আর নেই, বাড়িতে যে এখন কল খুললেই জল ! পাকা বাথরুম এ স্নান করতে করতে মন কিন্তু চলে যাছিল সেই কুড়ি বছর আগের নদীতে। সবাই মিলে নামতাম। তখন তো সাঁতার ও জানতাম না। ..কিন্তু কি মজাই না হতো ।গামছা দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা, বালি খুঁড়ে জল বার করার চেষ্টা , গ্রামের মেয়েদের ডুব সাঁতার দেখে আনন্দে হাততালি দেওয়া  ...আরো কত কিছু। নদীর জলে দুতিন ঘন্টা কাটিয়ে যখন বাড়ি আসতাম, পেটে তখন ভীষণ খিদে । দালানে মাটিতে বসে সবাই ভাত খেতাম , চোখ জুড়িয়ে আসত  ঘুমে আর ক্লান্তিতে । বিকেলে মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি , তারপর আবার খানিক্ষণ আবির খেলা। সারাদিন কত আড্ডা , কত মজা !

কুড়ি বছর অনেকটা সময় । লাইট পাখা বদলেছে ঠিকই তবে কিছু জিনিস ঠিক আগের মতন ।
এত বছর পরেও  রেবী পিসি চোখ ছলছল করে জড়িয়ে ধরল।
বলল "এত বছর পরে এলি ক্যানে? আমাদের জন্য মন খারাপ করে নাই? জামাইটারে, নাতিটারে আনলি না ক্যানে?"। তারপর নিজের হাতে বানিয়ে মুচমুচে মাছ ভাজা খাওয়ালো। দীর্ঘ কুড়ি বছর পরে দেখা হলো। বয়স বেড়েছে আমার, রেবী পিসির  --দুজনেরই । কিন্তু সম্পর্ক যেন ঠিক আগের মতন। একটুও  বদলায় নি।খুব ভালো লাগলো ।
একটা ছোট্ট ছেলের সাথে আলাপ হলো। নাম অরিত্র । এমন "মাসি মাসি " করে জড়িয়ে ধরল যেন কত চেনা । খুব মায়া পরে গেল দুদিনেই ছেলেটার ওপর । কেন জানি বার বার মনে হলো যে গ্রামের লোকেদের ফীলিংস খুব "জেনুইন " একেবারে অকৃত্তিম!
ভালো লাগলো দেখে যে গ্রামের স্কুলটা  কত বড় হয়ে গেছে । অনেক ছেলে মেয়ে পড়াশোনা করছে । ছোট ছোট মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুল  যাছে ।গ্রামে একটা dispensary খুলেছে। ঘরে ঘরে পাকা toilet হয়েছে ।লাইট জ্বলছে, পাখা চলছে। গ্রামের অনেক লোকের হাতে মোবাইল ফোন।  উন্নতি হয়েছে প্রচুর।

না, এবার মাঠে যেতে হয়নি । সুন্দর ঝকঝকে toilet । আবার ওয়েস্টার্ন স্টাইল । কনসেপ্টটা "attached বাথরুম" -এর কিন্তু বাড়ি থেকে দুই পা দুরে । নিরিবিলি, কোকিলের ডাক ,তাল গাছের পাতার সরসর আওয়াজ! ।
Nature's  call indeed !




খুব আনন্দ করে এলাম। তিনদিন ছিলাম কিন্তু একবারের জন্য মনে হলো না যে কুড়ি বছর পর গেছি ।
যেন এই তো সেদিন   ........
প্লেন যখন হল্যান্ড এর মাটি ছুঁলো, মনে হলো একটা অন্য জগত থেকে ফিরলাম ।
কাল সোমবার । অফিস আছে, স্কুল আছে   .....ভগলপুর অনেক দুরে।......




[ফটোগ্রাফারদের ধন্যবাদ।....]