Tuesday 15 September 2015

আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে



হল্যান্ড -এর আকাশে ঘন কালো মেঘ । সাথে বেশ ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া । সুজ্জিমামার পাত্তাই নেই। না আছে কাশ ফুলের মাঠ, না আছে শিউলি ফুলের গন্ধ । না আছে পাড়ার প্যান্ডেল বাঁধার তোড়জোড়। না আছে পুজোর বাজারের রমরমা । তবু যে কেন মনটা পুজো পুজো করছে কে জানে । ক্যালেন্ডার এর দিকে তাকালেই কেন যে মাথার মধ্যে দিন গোনা শুরু হয়ে যাছে বুঝতে পারছি না । ষষ্ঠী আর ৩২ দিন বাকি ।
আসলে যখন হল্যান্ড এ পুজো হতো না, তখন এতটা পুজো মিস করার গল্প ছিল না । কেমন জানি একটা হালছাড়া "সবই ভাগ্য" বলে মেনে নিয়েছিলাম। পুজো মিস করাটাও কেমন জানি অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো। অনেকে যেতো পুজো দেখতে Koln. আমরাও একবার Frankfurt গেছিলাম পুজো দেখতে, ইন্দ্র্দার বাড়ি। খুব ভালো লেগেছিল । 
তারপর ৫ বছর আগে হুজুগ তুলে দূর্গা পুজো শুরু করা হলো হল্যান্ড এ । এখন সেই পুজো ছেড়ে আমি কলকাতার পুজো দেখতে যেতেও রাজি নই আর । এ যেন আমাদের বাড়ির পুজো ।"কল্লোল" এর পরিবারের পুজো । এমন লাগে পুজোর চারটে দিন যেন এই পুজো দেখেই আমি বড় হয়েছি।
এতই আপন, এতই নিজের । 
বাঙালির উত্সাহ জগত বিখ্যাত ।কুমোরটুলি থেকে মা দুগ্গা & family নিয়ে এসে হাজির করলো হল্যান্ড এর মাটিতে । সঙ্গে এলো ঢাক ,পঞ্চপ্রদীপ, কাঁসর ঘন্টা, শাঁখ এবং আরো অনেক জিনিস যা এখানে পাওয়া মুশকিল । এবার খুঁজে বার করা হলো একটি হল, এখানে তো প্যান্ডেল বানানো সম্ভব নয়। হলের লোকজনকে বসিয়ে বোঝানো হলো দুর্গাপুজোর মানে। মুখে বোঝানো আর নিজের চোখে দেখা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস,। হলের কর্মর্কর্তারা যখন নিজের চোখে দেখলেন  তখন তো তাদের চক্ষু ছানাবড়া! 
এত লোক? এত খাবার? এত পুজো? এত আওয়াজ ? এত সাজ? এত গান? এত নাচ?
হোম যজ্ঞ দেখে তো তাদের fire brigade ডাকার অবস্থা! তবে গত ৫ বছর পুজো দেখার পর আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে হলের Wesley নামক ডাচ ছেলেটি এবার অষ্টমীতে আমাদের সাথে অঞ্জলি দেবে চোখ বুজে হাত জোড় করে !!
আমাদের পুজো হয় চারদিন ধরে -ঠিক ইন্ডিয়ার মতন । বিদেশে বেশির ভাগ জায়গায় পুজো হয় উইকেন্ডে , শনি রবিবারের ছুটির সুবিধে নিয়ে । 
এখানের স্কুলে ছুটি থাকে না। ..তাই বাচ্ছারা আসে বিকেলবেলা । আমাদের ছেলেমেয়েরা দুর্গাপূজো কতটা বোঝে জানি না তবে এই একসাথে হবার মজাটা খুব উপভোগ করে । আমার দশ বছরের ছেলে পুজোর হল এ যায় বন্ধুদের সাথে খেলতে। এক বয়সের অনেকগুলো বাচ্ছা সারা বিকেলে ipad এ খেলে কাটিয়ে দেয়। হলে একটা ছোট্ট কাউন্টার এ  ড্রিঙ্কস এবং চিপস পাওয়া যায়। ছেলের হাতে ৫ ইউরো দিয়ে রাখি।..খুব খুশি হয়, ইচ্ছে মতন চিপস আর কোলা কিনে খেতে পারে বোলে ।
আমার মনে পড়ে যায় আমার ছোটবেলার কথা । জামশেদপুরে বাড়ির পাশেই পুজো। সারা বছর অপেক্ষা। ..স্কুল ছুটি হলেই পরের দিন বাসে চেপে জামশেদপুর। জ্যাঠতুতো দুই বোন আর এক দাদা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত আমাদের টেম্পোর অপেক্ষায়। এক ছুট্টে আসত। আমি আর ভাই মিলে ৫ জন।টেম্পো থেকে নেমেই বাড়ি না ঢুকে সোজা পুজোর জায়গায়। ঠাকুরের তখন চোখ আঁকা হচ্ছে কিম্বা ঘাম তেল লাগানো হচ্ছে, বাংলায় যাকে বলে ফিনিশিং টাচ!। খুব ভালো লাগত দেখতে। তারপর বাড়ি গিয়ে খেয়ে দেয়ে উঠেই মা সুটকেস খুলত আর জেম্মা আলমারি। নতুন জামাকাপড় দেখাবার পালা । আমাদের তিন্ বোনের জন্য একরকমের জামা বানাতো মা, আবার এক রকম জামা বানাত জেম্মাও । ছোটমামা ইয়ার্কি মেরে বলতো, "থান কিনে পর্দা আর মেয়েদের জামা বানিয়েছে"।  একটু দুরেই আমার মামাবাড়ি। বিকেলে সেখানে গিয়ে সবার সাথে দেখা কোরে খানিকক্ষণ আড্ডা মেরে আসতাম ।
পুজোর দিনগুলো সকালে চান সেরে নতুন জামা পড়ে পুজো প্যান্ডেলে যেতাম।সাথে একটা পার্সে টাকা। এক এক দিন এক এক জনের পালা টাকা দেবার। কোনদিন ঠাকুমা, কোনদিন জেঠু, কোনদিন বাপি, কোনদিন পিসি, কোনদিন মামাবাড়ি। সে এক দারুন আনন্দের ব্যাপার--নিজের খুশি মতন সেই টাকা খরচ করা। আমরা চার ভাইবোন ১০ টাকা কোরে পেলে, ভাই পেতো ৫, অনেকটা ছোট ছিলো বোলে! সেই টাকাটা আবার ও ভরসা করে কেবল মাত্র জেঠুকে রাখতে দিতো। জেঠু "বুড়ো" বলতে অজ্ঞান, সেইটা ভাঙিয়ে ভাই দিনের শেষে ৫ কেনো, ২৫ টাকা উঠিয়ে নিতো জেঠুর থেকে !!!
আমরা তিন বোন আরো অনেক বন্ধু নিয়ে পুজো প্যান্ডেলে বসতাম, খুব আড্ডা হতো । মাঝে মাঝে উঠে নয় ফুচকা, নয় এগরোল, নয় মোগলাই খাওয়া হতো । ফুচকাওয়ালার সাথে "এক টাকায় চারটে কেন, পাঁচটা নয়"..এই ঝগড়া গুলোর মজাই আলাদা ছিলো ।কখনো কখনো আবার বেশ একটা "দিদি দিদি" ভাব নিয়ে মামাত-মাসতুতো ভাইদের নিজের পয়সা থেকে বেলুন কিনে দিতাম --দারুন একটা গম্ভীর ফিলিং ।
বিকেলে আবার অন্য জামা ।অষ্টমীতে মায়ের থেকে নেওয়া একটা শাড়ি, মায়েরই ব্লাউস টেকে পড়তাম ---উফ কি excitement !
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ির বারান্দায় সবাই মিলে বসতাম। তখনও  প্যান্ডেলে লোকের ভিড়। ঝলমলে আলো  চারিদিকে । আমরা  সবাই মিলে লোক দেখতাম। ..তবে একটু বেশি রাত হলেই বাপি "রাত হয়ে গেছে, শুয়ে পড়ো, কাল সকালে এ ওঠা আছে" বোলে আড্ডা ভঙ্গ করে দিতো । "কাকুর" ওপর কারুর কথা বলার সাহস ছিল না। .
;-)
দশমীর দিন খুব মন খারাপ লাগতো । সব থেকে কষ্ট লাগত যখন প্যান্ডেলটা খোলা হতো । রঙিন ঝকঝকে কাপড় সরে গিয়ে শুধু মাত্র বাঁশ গুলো দাড়িয়ে থাকত। মনে পড়ে যেত আর মাত্রকটা দিন পরেই দুর্গাপুর ফেরার পালা। থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর ! জেঠতুতো , মামাতুত , মাসতুতো  সব ভাইবোনদের ছেড়ে আবার নিজের জায়গায়।....
ঠাকুর ভাসান দিয়ে ফিরে হারুজেঠু শান্তি জল ছিটিয়ে দিতেন মাথায় ।সবাই "এই যে এদিকে এদিকে, আমরা পাইনি আমরা পাইনি" বলে আরো শান্তির দাবি করতো। তারপর সবাই দল বেঁধে আসতো আমাদের বাড়ি। ঢিপ ঢিপ প্রনাম আর কোলাকুলির পালা --সাথে প্লেটে ঘুগনি, মিহিদানা, নারকোলনাড়ু আর চানাচুর!! সেটা খেয়েই ছুটতাম মামাবাড়ি। সেখানে প্রনাম সেরেই দিদার বানানো লুচি আর আলুর দম। ওমনি আলুর দম আর কোনদিন কোথাও  খাইনি ! বিজয়া দশমী শেষ !

"মা মা,  আমার গিটার ক্লাস আছে, চলো "

ছেলের ডাকে চমকে উঠলাম। জামশেদপুর থেকে সোজা ফিরে এলাম  হল্যান্ড !
নাহ, যাই রেডি হই, ছেলের গিটার ক্লাস আছে..........................