Saturday 5 March 2016

কলম কালি দোয়াত



ছোট্টবেলা থেকে পেন, পেন্সিল, রাবার ইত্যাদি যাবতীয় stationary  আমার খুবই প্রিয়। তবে সব থেকে প্রিয় পেন। সব রকমের -- লাল, নীল ,কালি, ডট  ... সব সব। পকেটে একটু পয়সা এলেই পেন কিনতাম । কেউ কিছু দিতে চাইলেই পেন চাইতাম । বই এর দোকানে গেলে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতাম পেনগুলোর দিকে ।
ওরা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতো । এর জন্য কম বকা খেয়েছি?
কোনো কাকু হয়ত বাবার সাথে দেখা করতে এসেছেন কাজে ।  কাকুর বুক পকেট থেকে  পেনটা উঁকি ঝুঁকি মারত, আমাকে ডাকত। আমি নির্লজ্জর মতন দেখতে চাইতাম পেনটা। হাতে পেয়ে এক টুকরো কাগজ এ একটু লিখে তবে শান্তি পেতাম। বুঝতে পারতাম মা পেছনে চোখ বড় করছে কিন্তু এ এক অদ্ভূত হাতছানি  ...বোঝাতে পারব না ।

ক্লাস ফোরে পেন্সিল ছেড়ে কালি পেন এ লিখতে বলল স্কুল থেকে । মনে পড়ে একটা অদ্ভূত বড় হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়েছিল। পেন এলো, সাথে এলো কালির দোয়াত। প্রথম দিকে মনে পরে দোয়াতের ঢাকনায়  কালি ঢেলে তারপর খুব সাবধানে পেনে কালি ভরতাম । কিছুদিন পরে বাবা একটা সাদা ড্রপার এনে দিলো ।ওটা দিয়ে কালি ভরা খুব সহজ হয়ে  গেল। টেবিল, টেবিল ক্লথ আর মা  --  সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

আমার অজস্র পেন এর কালেকসন থেকে রোজ নিত্যনতুন পেন বার করে লিখতাম । কখনো কিছু না লেখার থাকলেও পেনগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম। কোনোটায় কালি ভরতাম, কোনোটায় নিব বদলাতাম, কোনোটা মুছে রাখতাম   ....ভিষণ ভালবাসতাম ।
মনে পড়ে সেই কালি মোছার কাপড়টা? একেবারে মডার্ন আর্ট !
মনে পড়ে ডট পেনের রিফিল খালি হলে কেমন রিফিলের পেছনে জোরে ফু দিলে আরো একটু লেখা যেতো?
মনে পরে দুই হাতের তালুতে রিফিল্টা ঘষে নিলে কেমন আরেকটুখন চলতো রিফিলটা ?
মনে পরে পরীক্ষার আগের দিন সব পেনগুলোতে কালি ভরার কথা? 
মনে পড়ে যখন চার রংওয়ালা  ডট পেন বেড়োলো? একই পেন দিয়ে লাল নীল কালো সবুজ লেখা।
উফ কি excitement !!
.. হাতে iphone  পেয়ে অত excitement হয়েছিল কিনা সন্দেহ ।

তারপর শখ হলো একটা চাইনিস ফাউন্টেন পেনের।তার আবার নিজস্ব্ ড্রপার লাগানো। সে এক দারুন ব্যাপার।কিন্তু পেনগুলোর খুব দাম। ক্লাস নাইন এ মা প্রথম কিনে দিল একটা। কি যে যত্ন তার ! কোথায় যে তাকে রাখব ভেবে পেতাম না...পেন্সিলবক্স এর অন্যান্য 'সাধারণ' পেনগুলোর  সাথে রাখা কি ঠিক হবে? 
পরের ভাইফোঁটাতে আবার লাভ হলো ওই পেন....আহ্লাদে আমি ষোলখানা (আটখানা x ২)!!

যখন বেনারস পড়তে গেলাম, তখন প্রত্যেক মাসের খরচা বাবদ হাতে একটা ফিক্সড টাকা আসত বাবা-মার থেকে। । এর থেকেই মেসের খাওয়াদাওয়া, অল্প বিস্তর বাজার, দুএক খানা সিনেমা দেখা, গঙ্গার ঘাটে মাঝে সাঝে বোটিং, পরীক্ষার আগে বাবা বিশ্বনাথকে পুজো দেওয়া। ..এইসব হতো । আমার আবার তার থেকে অল্প টাকা বাঁচিয়ে দু একখানা পেন কেনার বাতিক ছিল।
হোস্টেলে থাকাকালীন এক life long বন্ধু হলো "সু"। সে আমার পেনের প্রতি এই মোহ দেখে নিজের মাসকাবারি টাকা থেকে প্রত্যেক মাসের এক তারিখে একটা করে পেন কিনে দিতে শুরু করলো।আরেক অদ্ভূত আনন্দ - অপেক্ষা করে থাকতাম মাসের পয়লা-র জন্য। কোনদিন ভুলতো না "সু"!

এরপর পড়াশোনার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম জাপান।জাপান যেন কলম-প্রেমিকদের স্বর্গ !! কি যে সুন্দর সুন্দর পেন। আমি তো এক কথায় পাগল হয়ে যেতাম পেনের দোকানে গেলে।যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনি সুন্দর লেখে। স্কলারশিপের পয়সা পেনের দোকানে খরচা করতে বেশ লাগত। ..এছাড়া প্রত্যেক মাসের এক তারিখে  "সু" এর নাম করে নিজেকে একটা পেন কিনে দিতাম।
কত লিখতাম তখন। পাতার পর পাতা চিঠি লিখতাম।নিজে মুখেই বলছি, হাতের লেখা আমার বেশ ভালো ছিল এক কালে।সমস্ত স্কুল মিলে হাতের লেখায় ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম একবার।এখন স্বপ্ন মনে হয় ।
বিয়ের পর কর্তা ও এমনি হিরে-জহরত-চাইনা-পেন-চাই বউ পেয়ে খুশি হয়ে মাঝে মাঝেই সুন্দর সুন্দর পেন কিনে দিতো।
;-)
এরপর এলো কম্পিউটার এর যুগ । লেখালেখি কমতে লাগলো ।কম্পিউটার এর কিবোর্ডে টকাটক টাইপ করে 'লেখা' শুরু হলো ।ঝকঝকে লেখা ঠিকই তবে কোনো character নেই। হাজার  রকম ফন্ট থেকে বেছে নেওয়া যায় পছন্দ মতন 'হাতের লেখা' কিন্তু কি যেন missing !কোথায় যেন একটা পার্সোনাল টাচের অভাব।
সারাদিনে অনেক কিছু লিখি। প্রচুর ইমেইল লিখি, ব্লগ লিখি, বাজারের লিস্ট লিখি, ফেস বুকে স্টেটাস লিখি ,...আরো কত কিছু লিখি।..কিন্তু সত্তি যেন কিছুই লিখি না। টকাটক টাইপ করতে করতে হাতের লেখাটাও কবে হারিয়ে গেছে।
আজকাল কখনো পেন দিয়ে কিছু লিখলে, কি লিখেছি সেটা বুঝতে নাজেহাল হয়ে যাই...
কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং!! 

---পেনগুলো ও যেন কেমন অভিমান করে আসতে আসতে সরে গেল আমার জীবন থেকে।কেউ ভেঙ্গে গেল, কেউ হারিয়ে গেলো, কারুর কালি শুকিয়ে গেলো। ...আসলে এত ভালবাসা থেকে এত অবহেলা ওদের সহ্য হলো না ।

~*~*~*~*~
২০১৫। অনেক বছর বাদের কলেজ reunion ।
আমরা কজন সেই "life long" বন্ধুরা আবার একসাথে হলাম। কেমন আনন্দ হলো সেটা লিখে বোঝাতে পারব না । ঠিক যেন সেই পুরনো দিনগুলো ফিরে পাওয়া।হাহা হিহি । একে অপরের জন্য নানা রকম উপহার । 
সব উপহারের শেষে "সু" ব্যাগ থেকে একটা পেন বার করে দিলো । 

"দয়িতা , তোর এই মাসের পেনটা ".....

মনটা কেমন আনন্দে নেচে উঠলো ! জেগে উঠলো সেই সুপ্ত পেন-প্রেম । 
কিন্তু তার থেকেও অনেক বড় পাওয়া এই মিষ্টি মনে রাখা.....
"life long "!!!!



photo: www.fountainpennetwork.com




No comments:

Post a Comment