খুব যত্ন করে হরিভাউ বানিয়েছেন আমাকে। উনি থাকতেন মুম্বাই এ, হয়তো এখনো আছেন । হরিভাউ স্বপনে জাগরণে শুধু গান বাজনা ভাবতেন - ওনার বানানো তানপুরা, সেতার , গিটার দেশের এবং বিদেশের নানা কোণে ছড়ানো । আমি তাদেরই মধ্যে একজন।
আমি তানপুরা ........
একদিন দোকান এ বসে হরিভাউ ফোনে কারুর সাথে কথা বলছিলেন । ফোন রেখে উনি আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন - একবার বাজালেন- আমার চারটে তার এক সুরে বেজে উঠলো - কেন জানি না আমার অজান্তেই বাজলো বিদায়ের সুর|বুঝলাম এবার যেতে হবে । অন্যান্য কিছু বন্ধু বান্ধবের সাথে পাড়ি দিলাম সাত সমুদ্র পেরিয়ে একটা ছোট্ট দেশে- ওলন্দাজদের দেশ ।
হল্যান্ড ।
এসে নামলাম Rotterdam এ - সেখান থেকে সোজা সামসুদ্দিন ভাইয়ের দোকানে । সারা রাস্তা জানলা দিয়ে বাইরে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম- কি সুন্দর এই দেশ । মনে মনে ভাবলাম কি জানি এরা কেমন মানুষ ! আবার ভাবলাম যেমনই হোক না কেন, আমি আমার সুরে সুরে দেশটা ভরিয়ে দেবো । আমার সহযাত্রী দুই সেতার ও এক সরোদ ও নিশ্চয় তাই ভাবছিলো - সবাই জানলার দিকে তাকিয়ে একটু যেন আনমনা। আসলে বিদেশের মাটিতে জীবন কেমন কাটবে- মাথার মধ্যে অনেক চিন্তা .....
পরেরদিন সকালেই সামসুদ্দিন ভাই আমাদের ঝেড়ে মুছে সাজিয়ে দিলেন ওনার দোকানে । এবং তার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই দোকান এ দুই ডাচ মহিলার আগমন । কি যে দুজনে খসখস ঘষঘষ করে বললেন সামসুদ্দিন ভাইকে (অবাক হয়ে শুনলাম এদের ভাষা, কিছু বুঝলাম না। এখন কিন্তু আমি ভাষাটা পুরো বুঝি 😊)
উনি আঙ্গুল তুলে আমার দিকে দেখালেন ।
দুজন কাছে এসে দাঁড়াতেই কি যে হলো আমার- যেন মনে হলো আমি এদের জন্যই তৈরী হয়েছি । কি শান্ত হাসি দুজনের মুখে । আমাকে দেখে ছোট শিশুর মতন চোখে আনন্দ । আবার নিজেদের মধ্যে সেই খসখস ঘষঘষ ভাষায় কিছু বলাবলি হলো ।
একজন এগিয়ে এসে আমার তারে হাত দিলেন।
আমি উত্তর দিলাম ....সা ....
উনি ওনার বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে হেসে ইশারা করে বললেন কিছু বাজাতে, দ্বিতীয় মহিলা ও এসে ছুঁলেন আমাকে।
আমি বললাম ..... পা ......সা ......
অনেক প্রশ্ন , আমার এক উত্তর ...পা ...সা.....সা .....
চোখ মুখ এবং কথা বলার আনন্দ দেখে বুঝলাম খুব পছন্দ হয়েছে আমাকে ।
ফেলিন আর মিরা । ভালোবাসায় ভরা সংসার দুই বান্ধবীর ।
বাড়িতে নিজেরা Yoga ক্লাস করে। সেই ক্লাসে তানপুরা বাজাতে চায়, আমাকে সযত্নে নিয়ে এলো বাড়ি । আমার যে কি ভালো লাগতে শুরু করলো - রোজ সকাল এ ক্লাস হয়, আমাকে ঘিরেও নানা কৌতূহল, মন প্রাণ ঢেলে সুরের ঢেউ তুলতে লাগলাম। ওদের হাসি কান্না ভালোবাসা -সব মিলিয়ে জীবন চললো । কেটে গেলো ১০ বছর ।
ফেলিন আজ নেই । ওর অনন্ত শেষ যাত্রাতে আমি মন প্রাণ উজাড় করে বিদায় জানিয়েছিলাম।
.. সা... .... পা ..... সা ....
মিরা মুভ করছে একটা ছোট এপার্টমেন্ট এ- সেখানে সব জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বয়স ও হয়ে গেছে, আমাকে বাজাতে চাইলেও হাতের ব্যথার জন্য বাজাতে পারেনা - arthritic wrist খুব বেদনাদায়ক।
শুনলাম বন্ধুকে বলছে ফোনে, কাউকে চেনো যে তানপুরা বাজাতে ইচ্ছুক? আমি বিক্রি করতে চাইনা কিন্তু এমন কাউকে দিতে চাই যে আমার আর ফেলিনের এই প্রিয় বাদ্যযন্ত্রটা ভালোবেসে বাজাবে ।
দুদিন পরেই বন্ধু হাজির।কাউকে বুঝি পাওয়া গেছে ।
বেরিয়ে পড়লাম আমার নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে ।
" D "
আমাকে হাতে পেয়ে চোখে মুখে ঝকঝকে উত্তেজনা । এক দেখাতেই বাড়িটা আর D কে আমার বেশ ভালো লাগলো । তবে বাজানো দেখেই বুঝতে পারলাম বহু বছর পর তানপুরাতে হাত দিচ্ছে । কিন্তু ছোঁয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত ভালোবাসা অনুভব করলাম - কেমন জানি আমাদের একটা কানেক্ট হয়ে গেলো - যেন এই বাড়িতে আসাটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিলো । নয়তো কোথায় হরিভাউ, কোথায় সামসুদ্দিন ভাই, কোথায় ফেলিন , কোথায় D -
আমরা কেমন করে এক তারে বাঁধা!
রোজ সকাল এ ঘুম থেকে উঠেই আমার তারে একটা ঝংকার দিয়ে তারপর D চায়ের জল বসায় । ঠিক যেন আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য একটা ঠেলা । তারপর সারাদিন নানা কাজে ব্যাস্ত থাকে ঠিকই তবে আমার প্রতি ভালোবাসাটা আমি স্পষ্ট অনুভব করি । অনেকদিন বাদে আবার গান শিখছে - গলা কাঁপে কিন্তু প্রচুর শক্তি পায় সুরের মাধ্যমে । রেওয়াজ করবো ভেবেও রোজ বসা হয়ে ওঠে না - একটু ফাঁকিবাজ ও আছে ।আমি কিছু বলিনা - তবে মুচকি মুচকি হাসি । আমাদের একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গেছে , অনেক মনের প্রাণের কথা হয় আমাদের ।
আমিও মনপ্রাণ দিয়ে সুরের শক্তি উজাড় করে দি D কে।
.. সা... .... পা ..... সা ....
রাগ ইমন, ভৈরব, কাফি, খাম্বাজ এসেছে আমাদের জীবনে - দুজন মেতে উঠেছি সুরে সুরে। ....
এরপর যেটা হলো সেটা একটা স্বপ্নের মতন ।
সকাল সন্ধে শুরু হলো এক আলোচনা - কৌশিকী চক্রবর্তী নাকি আসবেন নেদারল্যান্ডস - Cheerful Child এর fundraiser - সেই টাকা দিয়ে বাচ্চাদের স্কুল তৈরী হবে। আলোচনা যত বাড়তে লাগলো তত বাড়তে লাগলো উত্তেজনা । D যেন যুদ্ধে যাচ্ছে এমনি একটা ভাব । সারাক্ষন Youtube এ কৌশিকীর গান বাজছে বাড়িতে - ভুরু কুঁচকে নানা হিসেবে নিকেশ করছে কম্পিউটার খুলে - ফোনে নানা আলোচনা , প্লেনের টিকিট, কার গাড়ি যাবে, স্টেজ কে সাজাবে, ডিনার এ কি খাওয়ানো হবে - সে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার ।আমি তো চুপচাপ সব শুনছি আর ভাবছি ......
D -র পাগলামির কি শেষ নেই !!
হঠাৎ একদিন শুনি D ফোনে কৌশিকীর সাথেই কথা বলছে -
"আমার একটা তানপুরা আছে - তবে জানি না সেটা তোমার ঠিক লাগবে কিনা, এটা G # এ বাঁধা"
ব্যাস, আমার তো ঘুম গেলো উড়ে । সারা দিন রাত স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম যে স্টেজে আমি কৌশিকীর সাথে সুর মেলাচ্ছি ।
মন থেকে কিছু চাইলে শুনেছিলাম সেটা সত্যি হয় - the universe makes it happen. আমার জীবনেও ঠিক সেমনি কিছু হলো.
৩০ জুন : কৌশিকী নিজে হাতে আমাকে নতুন তারে বাঁধলো - ঠিক যেন নতুন জীবনের শুরু ।
প্রত্যেকটা ঝংকারে আমি উজরে দিলাম আমার মনের কথা, ধন্যবাদ জানালাম ঈশ্বরকে যিনি আমাকে এমনি সুযোগ দিয়েছেন - জগতে সুর ভরিয়ে দেওয়ার।
ছবিটা দেখো। বাঁদিক থেকে দ্বিতীয় - আমি !!
😊
এরপর জীবন কোথায় নিয়ে যাবে জানিনা - তবে D র কাছে থাকতে চাই সবসময় ।
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যেন যেখানেই থাকি, সুরে থাকতে পারি ।
আমি সুরে সুরে ওগো তোমায় ছুঁয়ে যাই.
নাই বা পেলাম দরশ তোমার, গানে গানে যেন তোমায় পাই। ......
30th June - "Blessings " concert Amsterdam |
ps :অনেকটা সত্যি, কিছুটা কাল্পনিক
আসাধারন। তানপুরা ভাবছে এই ভালবাসা ছেড়ে কোনভাবেই সে যাবে না। সুরে সুরে সে D কে ই বেঁধে রাখবে। আর সেটাই যেন হয়।
ReplyDeletethank you :-)
DeleteJibone ki pabona, bhulechi she bhabona.... Paona ja ta pabei... tanpura hok ba D 😃
ReplyDelete;-) thik tai....
Deleteসঙ্গীত এর অসীম শক্তি, অনেক অচেনা আর দূরের মানুষও এক সুরে বাঁধা হয়ে যায়। প্রার্থনা করি D ও তার তানপুরাও যেন চিরদিন এক সুরে বাঁধা হয়ে থাকে ♥️
ReplyDeletethik kotha, shotti osheem shokti music er...... :-)
Deleteashadharon
ReplyDeleteThank you❤️
Delete